অপারেশন সার্চলাইট: গণহত্যা ও নির্মমতার কালরাত আজ
২৫ মার্চের গণহত্যা, ছবি- ফোকাস বাংলাআজ ২৫ মার্চ।নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার ভয়াবহ ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে দেশব্যাপী সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে যখন ২৭ মার্চ হরতাল পালনের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল, তখনও জানা ছিল না কী ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করে সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিমান ঢাকা ত্যাগ করেছে।
রাজধানী ঢাকায় নিরীহ মানুষেরা যখন ঘরে ফিরেছে, তখনই তাদের হত্যার জন্য পথে নেমে আসে পাকিস্তান আর্মির ট্যাংক। ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’র মূল লক্ষ্য ছিল— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী- শিক্ষক, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় ইপিআরের বাঙালি জওয়ানেরা। পাশাপাশি টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও, টেলিগ্রাফসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ধ্বংস করে দেওয়া, যাতে ঢাকাকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা যায়।
সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং এরপর একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এর চারপাশ, ধানমন্ডি, পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দফতরসহ রাজধানীর সর্বত্র নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঢাকার বাইরে হত্যাযজ্ঞ চালায় চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষক। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় তাদের। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি।
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে বাঙালিরা আশা করেছিল, ক্ষমতার পালাবদল হবে এবং আওয়ামী লীগ ছয় দফা অনুসারে সরকার গঠন করবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) এর জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনা ও চাপে প্রাদেশিক পরিষদের কার্যাবলী মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করলে বুঝতে সমস্যা হয় না, এবার প্রতিরোধের সময় এসেছে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। বাংলার মানুষ প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলে তাদের মানসিক সামর্থ্য গুড়িয়ে দিতে পরিকল্পনা হয় ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানলের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৫ মার্চ যে ভয়াবহতা ঘটিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী, তা বাঙালিদের মনোবল গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাংলার মানুষ তখন জানে যে, কোনও আক্রমণেই তাদের আর পিছু হটানো যাবে না। রাতের অন্ধকারে ঢাকা রাস্তায় যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, সবার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বাঙালিদের প্রতিহত করার যে পরিকল্পনা করা হয়, তা সফল হয়নি। সেটি বুঝতে বেশি সময় লাগেনি পাকিস্তানি বাহিনীর। বরং তাদের এই নৃশংসতার কারণে আরও সুসংগঠিত হয়ে শাসকদের প্রতিহত করার কাজটি আরও ত্বরান্বিত করেছে।’
২৫ মার্চ কালরাত-এর শহীদদের স্মরণে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আজ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাঁদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শহীদ বেদিতে মোমবাতি প্রজ্বালন করবে জগন্নাথ হল পরিবার। এর আগে রাত ১১টায় হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মশাল মিছিল হবে। এদিকে একমিনিট আলো নিভিয়ে ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত পালনের ঘোষণা দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। আগামীকাল রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট এই কর্মসূচি পালন করা হবে। জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ও কেপিআই এই আয়োজনের বাইরে থাকবে। এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
গণহত্যা দিবসের কর্মসূচি
ভয়াল ২৫ মার্চ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
জাতীয়ভাবে আজ রাতে সারাদেশে একমিনিটের জন্য (কেপিআই ও জরুরি স্থাপনা ব্যতিত) প্রতীকী ‘ব্ল্যাক-আউট’ কর্মসূচি পালন করা হবে।
এ উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একপত্রে বলা হয়েছে—২৫ মার্চ রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট সারাদেশে এই প্রতীকী ব্ল্যাক-আউট কর্মসূচি পালিত হবে।
এছাড়া জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালনের অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রবিবার সকাল ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ গণহত্যার ইতিহাস’ শীর্ষক শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
আওয়ামী লীগ এদিন বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ঢাবি শিক্ষক সমিতির যৌথ উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের।
অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে—সন্ধ্যা ৭টায় স্মৃতি চিরন্তনে মোমবাতি প্রজ্বালন, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ও আলোচনা সভা। এছাড়া, বা’দ জোহর মসজিদুল জামিয়ায় ২৫ মার্চের রাতে নিহতদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হবে প্রার্থনা সভা। রাত ৯টা থেকে ৯টা ১মিনিট পর্যন্ত ২৫ মার্চ কালরাত স্মরণে জরুরি স্থাপনা ব্যতীত সবজায়গায় “ব্লাক-আউট” কর্মসূচি পালন করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলও এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে — ২৫ মার্চ কালরাতে নিহত শহীদদের স্মরণে জগন্নাথ হল পরিবারের পক্ষ থেকে হল প্রাঙ্গণে স্মরণ অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—বিকাল ৪টা ১ মিনিটে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সন্ধ্যা ৬টা ১ মিনিটে শহীদদের স্মরণে স্থাপনা শিল্পের প্রদর্শন (ইনস্টেলেশন আর্ট), দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা আবৃত্তি, নাটক (কালরাত্রি), রাত ৯টা ১ মিনিটে ব্ল্যাক আউট এবং গণসমাধিতে মোমবাতি প্রজ্বালন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ইত্যাদি।
রোকেয়া হলের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে যে সব নারী ও কর্মচারী পাকিস্তানি সামারিক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছিলেন, সেসব বীর নারী ও শহীদ কর্মচারীদের স্মরণে প্রথমবারের মতো রাত ৮টায় রোকেয়া হল পরিবার এক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। দলটির সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ অন্যান্য নেতারা এতে যোগ দেবেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল যৌথভাবে গণহত্যা দিবস স্মরণে রবিবার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে পুরানা পল্টনের মুক্তিভবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন পর্যন্ত আলোর মিছিলের আয়োজন করেছে।