খালেদার সাজা কেন বাড়বে না জানতে চেয়ে হাইকোর্টের রুল
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা কেন বাড়ানো হবে না—তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আর আদালত আদেশ দিয়েছেন, এই রুলের ওপর শুনানি হবে খালেদা জিয়ার আপিলের সঙ্গে।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ও বিচারপতি শহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ রুল জারি করেন। সাজা বাড়াতে দুদকের করা রিভিশন আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গতকাল আদালত এই রুল জারির আদেশ দেন। খালেদা জিয়া ও সরকারকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতের আদেশে বলা হয়, দুদক সাজা বাড়াতে রিভিশন আবেদন করতে পারে কি না সেটা নিয়ে আইনগত প্রশ্ন রয়েছে। এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা বা সুরাহার প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্যই রুল জারি করা হলো।
শুনানিতে দুদকের আইনজীবী বলেন, নিম্ন আদালত স্ববিরোধী রায় দিয়েছেন। একই অপরাধে অন্য আসামিদের ১০ বছর সাজা দেওয়া আর খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর সাজা দেওয়া আইনের দৃষ্টিতে বৈষম্যমূলক।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, দুদককে রিভিশন আবেদন করতে হলে আগে জাতীয় সংসদে আইন সংশোধন করতে হবে।
আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও এ জে মোহাম্মদ আলী। এ সময় ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী, ব্যারিস্টার মীর হেলালউদ্দিন, অ্যাডভোকেট সগির হোসেন লিওন প্রমুখ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ হোসেন ও এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইউসুফ মাহমুদ মোরশেদ।
গতকাল সকালে শুনানির জন্য সময় ধার্য থাকলেও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আপত্তি জানান। তাঁরা আদালতকে বলেন, দুদকের আবেদনের কপি তাঁদের দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় আদালত দুদককে তাদের আবেদনের কপি খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের সরবরাহ করতে বলেন। একই সঙ্গে দুপুরে শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করেন। পরে দুপুর ২টার বিরতির পর শুনানি শুরু হয়।
শুনানিতে খুরশীদ আলম খান বলেন, মামলার প্রধান অভিযুক্ত খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছর। অথচ সহযোগীদের দেওয়া হয়েছে ১০ বছর। আইনের দৃষ্টিতে এটা বৈষম্যমূলক। তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, আত্মসাৎ করা টাকার পরিমাণের কথা বিবেচনা করেই এ সাজা দেওয়া হয়েছে। রায়ের অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, যখন টাকা এসেছিল তখনকার হিসাবে এটা অনেক টাকা। যদিও বর্তমান বাজারমূল্যে এটা কম। তাই খালেদা জিয়াকে কম সাজা দেওয়া হয়েছে। দুদকের আইনজীবী বলেন, নিম্ন আদালতের বিচারক স্ববিরোধী যুক্তি দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হলেও এ ধারায় সাজা দেওয়া হয়নি। এ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর। আসামিদের এ ধারায় সাজা দিলে দুদকের সংক্ষুব্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু সাজা দিয়েছেন দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারায়।
এ সময় আদালত প্রশ্ন করেন, ৫(২) ধারায় যদি একজনকে চার বছর আর অন্যদের সাত বছর সাজা দেওয়া হতো তখন কী করতেন?
জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, তখন দেখা যেত।
এ সময় আদালত বলেন, ‘আমাদের দেশে সাজা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো নীতি নেই। সুনির্দিষ্ট আইন নেই।’
শুনানির একপর্যায়ে আদালত দুদক আইনজীবীর কাছে জানতে চান, খালেদা জিয়া মামলার মূল অভিযুক্ত হওয়ার পক্ষে কী প্রমাণ আছে?
জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, নিম্ন আদালতের রায়েই তা বলা আছে। এ ছাড়া এভিডেন্স রয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে টাকা এসেছে। ১৯৯৩ সালে এ টাকা দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এ সময় পর্যন্ত তা ব্যবহার না করে ফেলে রাখার মাধ্যমে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। নিম্ন আদালতের রায়ে এটা বলা হয়েছে।
কেন আপিল না করে রিভিশন আবেদন করলেন—আদালতের এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, আসামিকে খালাস দিলেই শুধু দুদক আপিল করতে পারে। অন্যথায় আপিল করতে পারে না। এ কারণে শুধু সাজা বাড়াতে রিভিশন আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর শারীরিক অসামর্থ্য, বয়স্ক মহিলা, একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান—এগুলো বলে তাঁকে (খালেদা জিয়াকে) ক্ষমা করার সুযোগ নেই।
আদালত তাঁর কাছে জানতে চান, পুরো রায়ের বিরুদ্ধে এ আবেদন কি না? জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, না। দুদক পুরো রায় চ্যালেঞ্জ করেনি। শুধু খালেদা জিয়ার সাজা বাড়ানোর জন্যই রিভিশন আবেদন করেছে।
এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন দুদকের আবেদনের বিরোধিতা করে বলেন, দুদক আইন একটি বিশেষ আইন। এ আইনে রিভিশন আবেদন করার সুযোগ নেই। দুদক শুধু আপিল আবেদন করতে পারে। তাও যদি কোনো আসামিকে খালাস দেয় সে ক্ষেত্রেই শুধু দুদকের আপিল করার এখতিয়ার রয়েছে। যেহেতু খালেদা জিয়াকে নিম্ন আদালত খালাস দেননি, তাই দুদকের রিভিশন আবেদন করার এখতিয়ার নেই। তিনি বলেন, এ আইনে রিভিশন আবেদন করতে হলে আইন জাতীয় সংসদে সংশোধন করতে হবে।
এ সময় আদালত বলেন, আদালতের রিভিশন করার ক্ষমতা রয়েছে; কিন্তু এটা কিভাবে ব্যবহার করবেন তা বলা নেই।
এরপর খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আইনে একটিমাত্র দরজা। আর তা হলো আপিল করা। রিভিশন করার এখতিয়ার নেই। আইনে দুদককে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই দুদকের রিভিশন আবেদন করার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা রয়েছে।
এরপর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, দুদক একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা কারো বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দুদক সেটা করেছে। দুদকের আইন অনুযায়ী নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা বাড়াতে দুদক রিভিশন আবেদন করতে পারে না। নিম্ন আদালতের সাজার ব্যাপারে তাদের সংক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। দুদক ভুল পথে এসেছে। তাই দুদক তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ বিচার শেষে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেন। রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং অন্য পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সব আসামিকে দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ৪৪টি যুক্তি তুলে ধরে গত ২০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আপিল আবেদন (১৬৭৬/২০১৮) দাখিল করেন খালেদা জিয়া। এই আপিল গত ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রহণ করে নিম্ন আদালতের দেওয়া জরিমানার রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট। পরে চার যুক্তিতে গত ১২ মার্চ হাইকোর্ট খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেন। এ জামিন আদেশের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল আবেদন গ্রহণ করে আগামী ৮ মে পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। এ অবস্থায় গত ২৫ মার্চ দুদক খালেদা জিয়ার সাজা বাড়াতে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদন করে।
খালেদা জিয়ার মামলার শুনানিতে মওদুদ : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা বাড়াতে দুদকের করা আবেদনের বিরোধিতা করে হাইকোর্টে শুনানি করলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ও বিচারপতি শহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ শুনানি করেন।
আদালত থেকে বেরিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেল থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন। আপনারা আদালতে ছিলেন। সবই তো দেখলেন।’
এরপর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, আজ আদালতে মওদুদ আহমদ শুনানি করেছেন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে মওদুদ আহমদকে নিয়ে প্রচারিত সংবাদ সঠিক নয়।