চট্টগ্রাম ও খুলনায় হাজার হাজার নলকূপ অকেজো
পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় হাজার হাজার নলকূপ অজেজো হয়ে পড়েছে। ফলে এসব এলাকায় পানীয়জলের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে।
মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট হয়েছে। ভূ-গর্ভস্ত পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হাজারো নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসীকে বিশুদ্ধ পানির খোঁজে হাঁটতে হচ্ছে অনেক পথ। ব্যক্তি উদ্যোগে নলকূপ বসানো হলেও কম গভীরতার কারণে আর্সেনিকের ঝুঁকি রয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল স্থাপিত গভীর নলকূপগুলো সুপেয় নিরাপদ পানির জন্য ৭শ থেকে ৮শ ফুট গভীরে যেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পানির স্তর কমে যাওয়া ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় চট্টগ্রামে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল স্থাপিত ৬৪ হাজার ৪৮৩টি নলকূপের মধ্যে ৬ হাজার ৩৮৯টি নলকূপ অকেজো অবস্থায় রয়েছে।
সূত্র জানায়, এবার নতুন করে চট্টগ্রাম জেলায় ১ হাজার ২০০ গভীর নলকূপ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় রিংওয়েল বসানোর মাধ্যমে পানি সংকট নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বেপরোয়াভাবে নলকূপ বসিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। পান করার উপযোগী পানি পেতে অনেক গভীরে যেতে হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় ৬৪ হাজার ৪৮৩টি গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে অকেজো নলকূপ রয়েছে ৬ হাজার ৩৮৯টি। এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অকেজো হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি নলকূপ অকেজো রয়েছে ১ হাজার ৭৮৫টি সন্দ্বীপে। অন্য উপজেলার মধ্যে সীতাকুণ্ডে ৭৪৭টি, পটিয়ায় ৫৭৭টি, লোহাগাড়ায় ৫৯৪টি, আনোয়ারায় ৪৯৯টি, বাঁশখালীতে ৪২৬টি ও রাউজানে ৪০২টি অকেজো নলকূপ রয়েছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় ১ হাজার ২শ গভীর নলকূপ বসানোর জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এ সব নলকূপের মধ্যে ৫০ শতাংশ স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ৫০ শতাংশ স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বরাদ্দ প্রদানের সরকারি নীতিমালা রয়েছে। তবে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এ সব নলকূপপ্রাপ্তদের ৭ হাজার ৫শ টাকা সরকারি রাজস্ব খাতে জমা দিতে হবে।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন রায় ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের সংস্থার উদ্যোগে পৌরসভার পানি সরবরাহ প্রকল্পগুলো নির্মাণের পর পৌরসভা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পরবর্তী সময়ে তারাই পরিচালনা করবেন।
এনামুল হক, খুলনা অফিস থেকে জানান, খুলনা বিভাগে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে গেছে। গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরুতেই শত শত নলকূপ পানিশূন্য হয়ে পড়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও মাঝারি সাইজের এক কলস খাবার পানি ১০/১২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। একটু বড় কলস হলে দাম আরো বেশি।
এদিকে, খুলনা মহানগরীর অধিকাংশ গভীর নলকূপও অকেজো হয়ে পড়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোটর ছেড়েও পানি উঠছে না। ফলে বাধ্য হয়ে অধিক শক্তিশালী সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর হিড়িক পড়েছে। আগামী বর্ষা মৌসুম না আসা পর্যন্ত পানির এ সংকট থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানা যায়, ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনায় কৃষি কাজের জন্য অতিমাত্রায় সেচ পাম্প দিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। কিন্তু লবণাক্ততার কারণে এ এলাকার পুকুরের পানিও পানের অযোগ্য। ফলে সুপেয় পানির অভাবে এ এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা স্বর্ণা রায় বলেন, জলের কষ্টে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আগে দুই থেকে তিন মিনিটে এক কলস জল ভর্তি করা যেত। কিন্তু এখন আধা ঘণ্টায়ও কলস ভরা সম্ভব হচ্ছে না। ইউপি সদস্য দেবব্রত সরদার বলেন, শোভনা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৫০টির বেশি গভীর নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপের গভীরতা অন্তত ৫৩০ ফুট। কিন্তু বর্তমানে মাত্র একটি নলকূপে পানি উঠছে। ফলে ১০ কিলোমিটার দূরে কাঁঠালতলা বাজার থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অথবা সেচ পাম্প থেকে ৫০ লিটার পানি ২০ টাকা দরে কিনে আনতে হচ্ছে। পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে।
একই অবস্থা আইলা বিধ্বস্ত উপকূলীয় উপজেলা কয়রায়। এ উপজেলায় পানির উত্স পুকুরগুলোতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মানুষের দুর্দশার অন্ত নেই। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় সরকারি ২ লাখ ১৬ হাজার ৩১৭ গভীর ও অগভীর নলকূল রয়েছে। খুলনার জেলাগুলোতে সরকারি নলকূপ অপেক্ষা ব্যক্তি মালিকানায় আরো পাঁচগুণ বেশি নলকূপ রয়েছে। সূত্র জানায়, চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে খুলনা বিভাগে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর ২৮ থেকে ৩০ ফুট নিচে নেমে গেছে। এদিকে, খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, নগরীর ১৫ লাখ মানুষের প্রতিদিনের পানির চাহিদা ২৪ কোটি লিটার। কিন্তু খুলনা ওয়াসা সরবরাহ করে মাত্র ১৩ কোটি ২০ লাখ লিটার। খুলনা সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং রয়েছে সাড়ে ৬৫ হাজার। কিন্তু মাত্র ১৮ হাজার গ্রাহককে পানি দেয় ওয়াসা। খুলনা নগরীর পানির চাহিদা শতভাগ উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভ থেকে। এর মধ্যে ওয়াসা ৮৩টি নলকূপের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৩ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে। বাকিটুকু নগরবাসী হস্তচালিত নলকূপ এবং নলকূপে পাম্প লাগিয়ে নিজস্বভাবে উত্তোলন করে।