মুশি ও তার টেস্ট টুপি
২০০৫ সালের ২৬ মে, লর্ডসে অভিষেক হলো এক তরুণ উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানের, যিনি এখন পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহিরুহে। আজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৩ বছর পূর্তি মুশফিকুর রহিমের। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে তাঁর। কিন্তু একটি জায়গায় বদলায়নি। লর্ডসে সেই যে ব্যাগি গ্রিন উঠেছিল তাঁর মাথায়, মুশফিক প্রতিটি টেস্ট খেলতে নামেন এটি পরে।
ক্রিকেটীয় অর্জন তো আছেই, ক্রিকেট স্টিভ ওয়াহকে মনে রাখবে আরও একটি কারণে অস্ট্রেলিয়া। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ব্যাগি গ্রিন টুপির চেতনা ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনিই। নিয়ম করেছিলেন, টেস্টের প্রথম দিনের মধ্যাহ্ন বিরতি পর্যন্ত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের ব্যাগি গ্রিন পরা বাধ্যতামূলক। ফ্লপি পানামা হ্যাটে অভ্যস্ত শেন ওয়ার্ন অবশ্য তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, কাজ হয়নি। স্টিভ ওয়াহর যে যুক্তি ছিল, সেটি উপেক্ষা করার সাধ্য ছিল না কারও, ‘ক্রিকেটারদের কত ঘাম আর রক্ত এই টুপির সঙ্গে জড়িত রয়েছে, এই টুপিকে সম্মান জানাতেই হবে।’
বাংলাদেশ ক্রিকেটে ব্যাগি গ্রিনের প্রচলনটা সেভাবে নেই। যদিও এখনো পর্যন্ত যে ৮৭ ক্রিকেটারের টেস্ট অভিষেক হয়েছে, প্রত্যেকেই একটি করে ব্যাগি গ্রিন টুপি পেয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগই মাঠে ব্যবহার করেন না, সযত্নে তুলে রাখেন শোকেসে। একজন অবশ্য ব্যতিক্রম—মুশফিকুর রহিম।
২৬ মে, ২০০৫—১৩ বছর আগে ঠিক এই দিনে লর্ডসে বাংলাদেশের ৪১তম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর মাথা উঠেছিল ব্যাগি গ্রিন। বছরের পর বছর টেস্টে এই টুপিটা পরে যাচ্ছেন মুশফিক। রং চটে গেছে, ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। টুপির কালচে সবুজ রংটাও এখন ধূসর। বাঘের ছবিসংবলিত বিসিবির লোগো প্রায় অদৃশ্য হয়ে যেতে বসেছে। তবু টুপিটার প্রতি এতটুকু টান, ভালোবাসা কিংবা আগ্রহ কমেনি মুশফিকের। ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণে খেলতে নামলে টুপিটা তাঁর মাথায় থাকবেই।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ দলের ইংল্যান্ডে সফরে সবচেয়ে চমক জাগানো গল্পের নামই ছিল মুশফিক। নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে অপরাজিত ১১৫ রানের এক ইনিংস খেললেন। নর্দাম্পটনের বিপক্ষে ওই অপরাজিত সেঞ্চুরির আগে সাসেক্সের বিপক্ষে ৬৩। ষোলো বছরের একটা ছেলে এত দুর্দান্ত খেলছে, ইংলিশ মিডিয়ায় হইচই ফেলে দিতে আর কী লাগে! স্কোয়াডে জায়গা পেয়েছিলেন দ্বিতীয় উইকেটকিপার হিসেবে। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচে এত ভালো ব্যাটিং করলেন যে ২৬ মে শুরু লর্ডসে প্রথম টেস্টে তাঁর অভিষেক ঘটল স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে!
সেই যে মাথায় উঠল ব্যাগি গ্রিন, সেটির সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়ার ব্রত নিয়ে মুশফিক প্রতিটি টেস্ট খেলতে নামেন এটি পরে। ‘টেস্ট আমরা খেলিই কম। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের মতো এত টেস্ট খেলার সুযোগ পাই না। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো যদি টেস্ট খেলার সুযোগ পেতাম ১২-১৩ বছরে আমার হয়তো ১৩০ বা ১৫০ টেস্ট খেলা হয়ে যেত। টেস্টের মর্যাদাই অন্য রকম। যতগুলো টেস্ট খেলি, এই আফসোস যেন না থাকে সেটার জন্য এটি পরি। টুপিটা পরলে আমার কাছে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। যত পুরোনো হবে, নোংরা হবে, যত ঘামের দাগ থাকবে, ততই মনে হবে, কিছু একটা হয়তো করেছিলাম’—মুশফিকের কাছে ব্যাগি গ্রিনের গুরুত্ব কতটা বুঝতেই পারছেন।
ব্যাগি গ্রিনের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি একটা আফসোসও কিন্তু বেরিয়ে এসেছে মুশফিকের কণ্ঠে। সেটি আসাই স্বাভাবিক। তাঁর পরে অভিষেক হওয়া অ্যালিস্টার কুকের কথা ধরুন। ইংলিশ ওপেনার যেখানে খেলে ফেলেছেন ১৫৪ টেস্ট, মুশফিক এখনো পড়ে আছেন ৬০ টেস্টে। ‘সত্যি বলতে কি, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো আর কেউ এখন টেস্টকে এতটা গুরুত্ব মর্যাদা দেয় না। এটাই সব সময় মাথায় কাজ করে। টেস্ট যদি খেলি, এর মর্যাদা যেন রাখতে পারি। আমার কাছে ব্যাগি গ্রিনের মর্যাদা তাই অন্য রকম’—বললেন তিনি। সংখ্যায় হয়তো অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়ের সঙ্গে পারবেন না, তবে ব্যাগি গ্রিনের প্রতি ভালোবাসায় পিছিয়ে থাকতে চান না মুশফিক।