প্রাণের ৭১

চীনে উইঘুরদের জিনজিয়াং এর পুলিশি রাষ্ট্র বানানোর অভিযোগ।

পুলিশি রাষ্ট্র মানে জনগণের স্বাধীনতার ওপর কঠোর আঘাত। পুলিশি রাষ্ট্রে নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতার জলাঞ্জলি আর কঠোর নিয়ন্ত্রণ। আধুনিক প্রযুক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে জনগণকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করার নানা সুবিধা তুলে দিয়েছে। এসব সুবিধা নিয়ে প্রযুক্তির সাহায্যে আস্ত দেশটাকে পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে ছাড়ছে রাষ্ট্রযন্ত্র। উদাহরণ দেওয়া যায় চীনের জিনজিয়াংকে। সেখানকার সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর প্রযুক্তি ব্যবহার করে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে আস্ত দেশটাকে পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে ছাড়ছে, তা নিয়ে এ লেখার প্রথম পর্ব আজ:
প্রযুক্তির আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এখন মানুষ। পালাবেন কোথায়? আপনাকে সব সময় চোখে চোখে রাখা হচ্ছে। কাজে যাচ্ছেন? সিসিটিভিতে ভিডিও চিত্র ধারণ করা হচ্ছে, আপনার চেহারা শনাক্ত করে রাখা হচ্ছে। গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে যাবেন, ক্যামেরায় আপনার নম্বর প্লেটের তথ্য রাখা হচ্ছে। পকেটের মোবাইল ফোনটির কথা বাদ দেবেন কেন? সেখানেও তো ক্রমাগত ডিজিটাল চিহ্ন তৈরি হচ্ছে। এমনকি ঘরের কোণে বসে একাকী ওয়েব ব্রাউজারে যা দেখছেন, সেসব কর্মকাণ্ডে সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। জীবনের কোনো অংশই বাদ যাচ্ছে না, অর্থাৎ আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের রেকর্ড রাখা হচ্ছে। কে রাখছে? কেন, রাষ্ট্রযন্ত্র আছে না!
প্রশ্ন হচ্ছে চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী একটি সরকারের অধীনে ‘ডিজিটাল মনিটরিং’ বা নজরদারির বিষয়টি কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে। ইকোনমিস্ট তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ডিজিটাল নজরদারির সুবিধা দেশটির কর্তৃত্ববাদী সরকারকে আরও ক্ষমতাবান করেছে। তারা দেশটিকে ভয়ংকর এক পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করছে। এ রাষ্ট্রের হাতে জনগণের সব ধরনের তথ্যই মজুত আছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশি রাষ্ট্র তৈরির বড় উদাহরণ চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। বিশেষ করে এর প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানকার লাখো মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর। বলা চলে, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর ব্যাপক নজরদারির মাধ্যমে একুশ শতকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে চীন সরকার।
ডিজিটাল নজরদারির এ বিষয়টি কি শুধু চীনেই রয়েছে? এর উত্তর হচ্ছে—না। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাও একই ধরনের নজরদারি করছে। তাদের কাছে থাকা উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করে অপরাধ ঠেকানো বা সন্ত্রাস প্রতিরোধের নামে মানুষের ওপর ব্যাপক নজরদারি করা হচ্ছে। এর ফলাফল যতই কার্যকর বলে প্রচার করা হোক না কেন, জনমনে নজরদারির বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর রমজানের শুরু থেকেই চীনে উইঘুরবিরোধী প্রচারণা জোর তালে শুরু হয়েছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, উইঘুর মুসলমানরা বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে পড়ছে। তাদের কাছ থেকে চীনের নাগরিকেরা নিরাপদ নয়। সেই অজুহাতে উইঘুর মুসলমানদের হেনস্তা করা হচ্ছে। উইঘুর মুসলমানদের কাছে ইসলামের চিহ্ন বহন করে, এমন যেকোনো জিনিস রাখা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তার পরেও যারা চীন সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে, এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১২ লাখের মতো উইঘুর মুসলমান আটক করা হয়েছে।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতা ও নিপীড়নের বিষয়ে ফারাক আছে। এ দুটির মধ্যেই একটি পদ্ধতি আছে, যাতে কোনো বিষয়ে নজরদারিতে জনগণের মতামত নেওয়া হয়। সরকারের ভারসাম্য রাখতে ও নজরদারির বেলাতে কিছু নিয়মের বেড়াজাল থাকে। এতে তথ্য সংগ্রহ ও তা কাজে লাগানোর পদ্ধতিকে দৃশ্যত আটকানো যায়। কিন্তু খুব সহজে তথ্য সংগ্রহ করা গেলে ওই সুরক্ষাব্যবস্থা আর থাকে না। তাই পুরোনো আমলের ঠিক করা প্রাইভেসির নিয়মকানুনগুলো হালের ই-মেইল, স্মার্টফোন আর ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের দুনিয়ায় আরও শক্তিশালী করার সময় এসে গেছে।
নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিনজিয়াংয়ের উইঘুরদের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে তা দুঃস্বপ্নের চরমে পৌঁছে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে। জিনজিয়াং এখন বর্ণবাদী পুলিশি রাজ্যে পরিণত হয়েছে। বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের ভয়ে চীনের শাসকযন্ত্র সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের এ পন্থা বেছে নিয়েছে। ফলে সেখানকার উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষ গণ-আটক হচ্ছে।
এ রাজ্যের রাস্তাগুলোর প্রতি ১০০ থেকে ২০০ মিটারের মধ্যে সিসিটিভি বসানো হয়েছে। সেখানে প্রতিবার গাড়ি নিয়ে বেরোনোর সময় প্রতিটি চালকের মুখ ও নম্বরপ্লেট ধারণ করা হচ্ছে। উইঘুরদের মোবাইল ফোনে সরকারিভাবে অনুমোদিত স্পাইওয়্যার রাখা হচ্ছে। তাদের আইডি কার্ডে নাম, পেশার মতো সাধারণ তথ্যের বাইরে আত্মীয়দের তথ্য, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, রক্ত, ডিএনএ, আটকের তথ্য এবং তারা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য সেসব তথ্য রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্টিগ্রেটেড অপারেশনস প্ল্যাটফর্ম (আইজিওপি) নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। এ সফটওয়্যার সন্দেহভাজনদের সম্পর্কে আগাম তথ্য দিতে পারে। তার ভিত্তিতেই আটক করা হয় অনেককেই।
এ সফটওয়্যারগুলো বা এ কাজে ব্যবহৃত অ্যালগরিদম কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য? বিশেষজ্ঞরা বলেন, পক্ষপাতযুক্ত সফটওয়্যার তৈরি করা অসম্ভব নয়। সফটওয়্যারের মাধ্যমে অপরাধী সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাসের যে পুলিশি পদ্ধতি আছে, তা নিখুঁত নয়। এর পরিবর্তে প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করা উচিত। ফেস রিকগনিশন পদ্ধতিও ভুয়া হতে পারে। পক্ষপাতদুষ্টভাবে তৈরি করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে প্রকৃত তথ্য উঠে আসতে না-ও পারে। তাই এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের আগে স্বচ্ছতা আনা জরুরি।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*