প্রাণের ৭১

তিস্তা চুক্তি মরিচিকা।

তিস্তা নদী হলো উত্তরের জীবনরেখা। তিস্তা তার জলদুগ্ধে উত্তরের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে। কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে। উত্তরের জনপদে তিস্তা অববাহিকার মানুষ তাই তিস্তার কাছে ঋণী। ২০১৪ সালে তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করার কারণে তিস্তা অববাহিকায় ভীষণ সংকট দেখা দিয়েছে। তিস্তায় যখন পানির প্রয়োজন ৫ হাজার কিউসেক, তখন পানি পাওয়া যায় মাত্র ২০০-৩০০ কিউসেক। কখনো কখনো এরও কম।
রংপুরের মানুষের সংকট সরকারের কাছে সব সময় কম গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রমাণ একবাক্যেই দেওয়া যায়। বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের সিঁড়িতে পা রাখছে, তখন রংপুর বিভাগের দারিদ্র্যের হার গত পরিসংখ্যানের হারের চেয়ে বেড়েছে। তিস্তায় পানি না থাকার কারণে যত সংকট দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে সরকারকে খুব বেশি বিচলিত হতে দেখা যায়নি।
তিস্তায় যখন পূর্ণমাত্রায় পানি আসত তখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হতো। সাধারণভাবে ধান চাষ করলে যে ব্যয় হয়, সেচ প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে সেই ধান চাষ করলে ব্যয় হয় ২০ ভাগের ১ ভাগ। রংপুরের মঙ্গা দূরীকরণে তিস্তা সেচ প্রকল্প অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। এখন সেই সেচ প্রকল্প কার্যত শুষ্ক মৌসুমে অচল। যে আট হাজার হেক্টর জমিতে রেশনিং সিস্টেমে পানি দিয়ে ধান চাষ করা হচ্ছে, তা নদীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। তিস্তায় পানি না থাকার কারণে আর অসংখ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। উত্তরের জীবনের জন্য তিস্তার পানির কোনো বিকল্প নেই।
তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা অনেক পুরোনো। দেশ স্বাধীনের পরপরই ১৯৭২ সালে তিস্তার পানি নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায় আলোচনা হয়। ১৯৮৩ সালে অন্তর্বর্তীকালীন একটি চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ছিল ৩৬ শতাংশ, ভারত ৩৯ শতাংশ আর ২৫ শতাংশ পানি ছিল নদীর নব্যতা বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে সেই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৭ সালে মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। এরপর আর কোনো চুক্তি হয়নি।
২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। আমরা তখন আন্দোলন করছিলাম ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে পানি বণ্টন হতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসঙ্গেই বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সফরের আগ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর এলেন না। মনমোহন সিং সহজেই বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়া তিনি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করবেন না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার খবর আমাদের পক্ষে উদ্ধার করা কঠিন। যদি তাদের মধ্যে এভাবেই ঘটনা সাজানো থাকে, মুখ্যমন্ত্রী পানি দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন আর এই সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী শুধু সময় নেবেন, তাহলে আমাদের ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হবে না।
২০১৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমরা আরেকবার আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা ছেড়ে আসার সময় সাংবাদিকদের সাফ জানিয়ে দিয়ে এসেছিলেন; তিস্তা নিয়ে কোনো কথাই তিনি বলবেন না। তবে তিনি বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন।’ তিস্তা প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী কারও ওপর কি আমাদের আস্থা রাখার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে? বরং এসব আলাপের দীর্ঘসূত্রতায় তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করে নিয়েছে ভারত। চীনের কাছ থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভারত বাংলাদেশকে আহ্বান জানায় পাশে থাকার জন্য, আর তিস্তার প্রসঙ্গে নীরবতা পালন করে। ভারত সরকার নদী প্রশ্নে দুই রকম নীতি গ্রহণ করেছে। ভারতের এই কৌশল বুঝেই বাংলাদেশকে তিস্তার পানির জন্য তৎপরতা চালাতে হবে।
তিস্তা নিয়ে নানান প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে। বাংলাদেশ কেন ভারতের কাছে তিস্তার পানি জোরেশোরে চায় না? ২০১১ সালে যখন পানিবণ্টন চুক্তি ভেস্তে গেল, তখন থেকেই যদি আমরা তিস্তার পানির জন্য ভারত সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকতাম, তাহলে ২০১৪ সালে একতরফা পানি প্রত্যাহার করত না। আমাদের উদাসীনতাও তিস্তার পানি প্রত্যাহারে সহযোগিতা করেছে কি না, তা-ও ভেবে দেখা প্রয়োজন। ২০১১ সালে যখন পানিবণ্টন চুক্তির প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়েছিল তখন পানিসম্পদমন্ত্রী ছিলেন রমেশচন্দ্র সেন। তাকে সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভালোভাবে যুক্ত করাই হয়নি। ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করার কারণে বাংলাদেশ কতখানি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তা-ও ভারতের কাছে তুলে ধরা হয় না।
তিস্তার পরিবর্তে এখন তোরসা, জলঢাকা নদীর পানির কথা বলছে ভারত। এটি তিস্তার পানি না দেওয়ার জন্য ভারতের নয়া কৌশল। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে আইনে পরিণত হয়েছে। সেখানে উজানের দেশ থেকে ভাটির দেশে প্রবাহিত নদীর পানি কীভাবে ব্যবহৃত হবে, তার দিকনির্দেশনা আছে। যে নদীর পানি যে খাতে প্রবাহিত হয়, সেই নদীর পানি সেই খাতে না রেখে খাত পরিবর্তন করলে তা নদীর জন্য কল্যাণের হবে না। ভারতের যেটি তোরসা নদী বাংলাদেশ তা দুধকুমার। ভারতের যেটি জলঢাকা, বাংলাদেশ তা ধরলা নদী। এ নদীতে এমন উল্লেখযোগ্য পানি থাকে না, যা দিয়ে তিস্তার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। আর এ দুটি নদীতে পানি থাকলেও তা দিয়ে তিস্তা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতো না।
২০১৪ সাল থেকে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করছে। আর আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতাও তিস্তায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের নদী নিয়ে দুই রকম কমিশন আছে। একটি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন আর একটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের যে আইন রয়েছে তাতে ভারতের সঙ্গে আলাপ করারÿক্ষেত্রে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আর যৌথ নদী কমিশন বছরে চারবার করে সভা করার কথা থাকলেও চার বছরে একবার করে বসে কি না, তার খবর আমরা পাই না। আর তা ছাড়া তিস্তা প্রসঙ্গে যৌথ নদী কমিশনের কোনো কার্যক্রম আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমরা মনে করি, তিস্তা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। অবস্থা দেখে মনে হয়, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির সম্ভাবনা অনেকটাই ঝিমিয়ে গেছে। চেষ্টা ঝিমিয়ে গেলেও ভারত কিন্তু বসে নেই। ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে বসে আছে। সুতরাং বড় চেষ্টা আসতে হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেই।

নিজস্ব প্রতিবদক






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*