সেই ডাক্তার কেন অস্ত্রধারী
আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ করতেন ডা. জাহিদ। উন্নতমানের চকচকে বিদেশি সব অস্ত্র আমদানি করাতেন বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর মাধ্যমেই। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এসব অস্ত্রই পৌঁছে দিতেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্যদের কাছে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এমবিবিএস ডিগ্রিধারী হয়েও প্রাণ নেওয়ার কারিগর হিসেবে দক্ষ হয়ে উঠছিলেন তিনি। হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল হিসেবে মাঝে মাঝেই ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’য়ের কাজও নিতেন বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। মিশন বাস্তবায়ন করাতেন পেশাদার কিলারদের মাধ্যমে। তবে ডা. জাহিদ কেন অস্ত্রধারী— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।গ্রেফতার জাহিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাবনা এবং কুষ্টিয়ায় স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করে ১৯৯২ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ডা. জাহিদ। ৩২ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। তবে ভালো ছাত্র হওয়ার পরও ছোটবেলা থেকেই অস্ত্রের প্রতি ঝোঁক ছিল তার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়েছেন এমন একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায়ই বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিজের সংগ্রহে রাখতেন। থাকতেন মেইন হোস্টেলে। প্রথম বর্ষে ডা. উত্তমকুমার বড়ুয়া গ্রুপের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তৃতীয় বর্ষে ওঠার পরই তিনি ডা. নারায়ণচন্দ্র দত্ত (নিতাই) গ্রুপে যোগ দেন। এ নিয়ে মেডিকেল কলেজে ডা. জাহিদ ‘পলিথিন জাহিদ’ হিসেবে পরিচিতি পান। পরে তিনি মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের মুরাদ-সাদী কমিটির যুগ্মসম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পান। অস্ত্রের পর তিনি জড়িয়ে পড়েন মাদকে। ২০০২ সালে এমবিবিএস পাস করেন ডা. জাহিদ। তবে তিনি কখনো সরকারি চাকরি পাওয়ার চেষ্টাও করেননি। দেশের বিভিন্ন জেলায় বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে চাকরি করেন জাহিদ। গ্রেফতারের আগে ময়মনসিংহের একটি ক্লিনিকে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ‘অ্যানেসথেসিয়া’ ডিপ্লোমা করেন জাহিদ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক ভিপি ডা. বিলিয়মঅনিমেষ সাংমা বলেন, ‘ডা. জাহিদ সহজ-সরল ছিল। তবে থ্রিলিং লাইফ পছন্দ করত। তবে অস্ত্রের প্রতি তার মারাত্মক ঝোঁক ছিল। বলতে পারেন অনেকটা শখ ছিল তার। তবে সে কন্ট্রাক্ট কিলার হতে পারে তা আমরা কখনো বিশ্বাস করি না।’ এতে অন্য কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে বলে দাবি তার।১৫ মে যাত্রাবাড়ী থেকে দুটি পিস্তল, আট রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করা হয় ডা. জাহিদকে। অস্ত্র আইনে মামলায় রিমান্ডে নিয়ে ৩ জুন গাবতলী থেকে তার স্ত্রী মাসুমা আক্তারকে একটি বিদেশি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল। ৭ জুন জাহিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ময়মনসিংহের বাগমারা থেকে ১২টি অস্ত্র ও ১ হাজার ৬১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তৃতীয় দফায় রিমান্ডে রয়েছেন ডা. জাহিদ। আজ রিমান্ড শেষে তাকে পুনরায় রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করবেন তদন্ত কর্মকর্তা।ডা. জাহিদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত তিনজন সন্ত্রাসীর কথা বলেছেন জাহিদ। তাদের মধ্যে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বাসিন্দা পেশাদার কিলার তাজুল মাঝেমধ্যেই তার কাছ থেকে অস্ত্র ভাড়ায় নিতেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতেন তিনি। উদ্ধার করা ১৫টি অস্ত্রের মধ্যে মাত্র তিনটি ভারতীয়, বাকিগুলো তাওরাস, রোজার, এসট্রা, টিটাস।তিনি আরও বলেন, র্যাবের সোর্সের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে গিয়ে এই তাজুল একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৫টি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১ হাজার ৬২২ রাউন্ড গুলির বেশির ভাগ তিনি ময়মনসিংহের গাঙ্গিনারপাড়ের খান আর্মসের কর্ণধার মো. শাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে কিনেছেন। তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এবার শাহাবুদ্দিন ও ডা. জাহিদকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।জাহিদ আরও জানিয়েছেন, তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকেই পাস করা চিকিৎসক। বাড়ি ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে। ওই সংসারে তার এক ছেলে রয়েছে। তবে বিয়ের তিন বছর পরই তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। চার বছর আগে ডা. মাসুমাকে বিয়ে করে ময়মনসিংহে বসবাস করছিলেন জাহিদ।এদিকে জাহিদের প্রথম স্ত্রী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অপকর্ম থেকে জাহিদকে সরাতে অনেক চেষ্টা করেছি। তবে কোনো কাজ হয়নি। ডিভোর্স নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না।’জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের বরাত দিয়ে কাউন্টার টেররিজমের স্পেশাল অ্যাকশন টিমের উপকমিশনার প্রলয়কুমার জোয়ার্দার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ অস্ত্রের কারবারে জড়িয়ে আছেন জাহিদ। ১৯৯৩ সালে তিনি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন। অতি সম্প্রতি তাজুলকে দিয়ে সিলেটে জাপার একজন সংসদ সদস্যকে ভাড়ায় খুন করার ছক আঁকেন তিনি।’তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্ত্র ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করতেন। বিদেশ থেকে অস্ত্র নিয়ে এসে জাহিদের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে দিতেন।আমাদের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জহুরুল হক জানিয়েছেন, কুষ্টিয়ার পোড়াদহের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান জাহিদ। তার বাবা হাবিবুর রহমান রেলওয়ের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। তার বড় ভাই একজন প্রকৌশলী। বোনদের সবাই উচ্চশিক্ষিত। জাহিদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, জাহিদুল আলম কাদিরকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি সন্ত্রাসী এবং তার অস্ত্রের ভাণ্ডার ছিল, তা মানতে পারছেন বাবা-মা। এ ছাড়া জাহিদ কোনো দিন ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।গতকাল হাবিবুর রহমান জানান, জাহিদ ১৯৯২ সালে এসএসসি পাস করার পর কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। হাবিবুর রহমান দাবি করেন, জাহিদ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ২০০২ সালে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বলেও দাবি করেন তার বাবা। ১৯৭০ সালে হাবিবুর রহমান নিজেও ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন বলে জানান। তিনি জানান, জাহিদুল ইসলাম বিয়ের পর ময়মনসিংহেই বসবাস করতেন। তবে ঈদের সময় তিনি গ্রামের বাড়ি আসতেন। কোনো দিন কোনো সন্ত্রাসী কাজে জড়িত ছিলেন না। তাকে সস্ত্রীক আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতার এবং পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অস্ত্রভাণ্ডার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা মানতে পারছেন না তিনি। তার দাবি, এটা একটা ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, ১৫ মে জাহিদকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় র্যাব। প্রায় এক মাস পর তাকে আটকের বিষয়টি জানানো হয়, এটি রহস্যজনক। এ ছাড়া র্যাব তাকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে আটকের কথা বললেও আসলে কুমিল্লার কোম্পানীগঞ্জ থেকে আটক করে। জাহিদ ওইদিন একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য কোম্পানীগঞ্জ গিয়েছিলেন। জাহিদের বাবা এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন