ভারতে মেয়েদের সম্পর্কে উঠতি বয়সী ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি কী
ভারতে নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কয়েক দশক ধরে জোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও কেন প্রত্যাশা-মত সুফল মিলছে না – সে সম্পর্কে সাম্প্রতিক এত সমীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইঙ্গিত মিলেছে।
শিশু বিষয়ক আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের সমীক্ষায় ভারতে নারীদের ব্যাপারে সেদেশের বয়ঃসন্ধির কিশোরদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্বেগজনক চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
সমীক্ষায় দেখো গেছে কিশোর আর তাদের অভিভাবকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও মনে করে যে সংসার সামলানোই নারীদের প্রধান কাজ এবং নারীরাই তাদের চাকরীর সুযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে। এদের বিশ্বাস – যৌন হেনস্থার জন্য প্রধানত নারীরাই দায়ী কারণ তারাই হেনস্থা-কারীদের প্রলুব্ধ করে।
অল্পবয়সী মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে সমীক্ষাটি চালানো হয় পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের ছয়টি রাজ্যের বড়-ছোট শহর আর ওই সমীক্ষাতেই কথা বলা হয়েছিল বয়ঃসন্ধির কিশোর আর অভিভাবকদের সঙ্গেও।
সেখান থেকেই উঠে এসেছে মেয়েদের নিয়ে বয়:সন্ধির কিশোর বা তাদের অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি।
ছয়টি রাজ্যের ৩০টি ছোট বড় শহর আর ৮৪টি গ্রামীণ এলাকার ৫৩৫৯ জনের মধ্যে চালানো হয়েছে ওই সমীক্ষা। এদের মধ্যে এগারোশোরও বেশী বয়:সন্ধির কিশোর আর ৮৪২ জন কিশোরীর অভিভাবকরা রয়েছেন। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বাকিরা কিশোরী বা সদ্য যুবতী।
মেয়েদের সুরক্ষা নিয়ে ভারতের ছয়টি রাজ্যে সমীক্ষাটি চালিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন।
সমীক্ষকদের প্রশ্নের উত্তরে ১১ থেকে ১৮ বছরের কিশোররা জানিয়েছে:
গ্রামীণ এলাকার ৬৬% আর শহর এলাকার ৬৩% কিশোর মনে করে মেয়েদের কাজ হল রান্না করা, কাপড় কাচা আর সংসারের দায়িত্ব সামলানো।
– প্রায় ৩৫% কিশোর মনে করে কথা না শুনলে মেয়েদের চড় মারা যেতেই পারে। সেটা নারী নির্যাতনের মধ্যে পড়ে না বলেই তাদের মত।
– ৩৬% গ্রামীণ কিশোর মনে করে যে মেয়েরা পুরুষদের চাকরী ছিনিয়ে নিচ্ছে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে কাজের কী প্রয়োজন, তাদের তো ভরণপোষণের জন্য কেউ থাকবেই।
– প্রায় ২৭% কিশোর মনে করেছে সরকার শুধু নারী অধিকার নিয়েই চিন্তিত, তাদের কথা ভাবা হচ্ছে না।
ধর্ষণ আর যৌন হেনস্থা নিয়ে কিশোরদের মতামত:
– শহর এলাকার ৩১% কিশোর মনে করে যে কিছু যৌন হেনস্থার ঘটনায় নারীরাই দায়ী, অথবা তারাই প্রলুব্ধ করেছে।
– গ্রামীণ এলাকার ৩২% আর শহরাঞ্চলের ৩০% কিশোর বলেছে কোনও নারী নিশ্চয়ই অসাবধানে এমন কিছু করেছে, যার জন্য তাকে ওই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
– শহর এলাকার ৩৮% কিশোর বলেছে কোনও নারী যদি ধর্ষণের সময়ে বাধা না দেয়, তাহলে সেটাকে ধর্ষণ বলাই যায় না।
– শহরের ৩৩% আর গ্রামের ৩২% কিশোর মনে করেছে, যে কোনও ধর্ষণের ঘটনায় নির্যাতিতা নারীর অতীত নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিত
যতজন অভিভাবকের সঙ্গে সমীক্ষকরা কথা বলেছেন, তাদের একাংশও এই প্রতিটি বিষয়কে সমর্থন করেছেন।
যেমন, শহরাঞ্চলের ৩৬% এবং গ্রামীণ এলাকার ৩৭% বাবা-মা মনে করেন যে মেয়েদের কাজ হল ঘরকন্না সামলানো। গ্রামের ৩৮% অভিভাবক আর শহরের ৩১% বাবা মা মনে করেছেন যে পুরুষদেরই বাড়ির সব ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত।
উল্লেখযোগ্য হল, একটা বড় অংশের মায়েরা জানিয়েছেন যে ধর্ষিতা নারী নিশ্চয়ই ওই পরিস্থিতির জন্য নিজে দায়ী এবং ধর্ষিতা নারীর অতীতও বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত।
আবার গ্রাম আর শহরের যথাক্রমে ৪৩ এবং ৩৯% অভিভাবক মনে করেছেন যে পরিবারের ছেলেদেরই ভাল করে পড়াশোনা করানো উচিত, কারণ তারাই ভবিষ্যতে পরিবারের দায়িত্ব নেবে।
সেভ দা চিলড্রেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান চিত্তপ্রিয় সাধু বিবিসিকে বলেন, “মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে একই বয়সের কিশোর বা অভিভাবকরা কী উপলব্ধি করছেন, এরকম কোনও তথ্য আমাদের কারও কাছেই ছিল না।”
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ বা গুরুতর অপরাধের সঙ্গে বয়:সন্ধিকালের কিশোররাই সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছেন।
কেন কিশোর বয়সে এ ধরণের অপরাধে তারা যুক্ত হয়ে পড়েছিল, সেই অনুসন্ধান কী তাহলে সঠিকভাবে করা হয় নি?
সর্বভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ক্রাই’য়ের তৃণা চক্রবর্তী বলছিলেন, “আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেক যৌন অপরাধের সঙ্গেই বয়:সন্ধিকালের কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে তো জঘন্যতম অপরাধগুলো এই বয়সের ছেলেরাই করছে। তারা বন্ধু-বান্ধবদের কাছে প্রমাণ করতে চায় যে, দেখো আমারও যথেষ্ট পৌরুষ আছে… আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।”
পুরুষ হওয়ার কারণেই যে সে একটি মেয়ের চেয়ে শক্তিশালী- এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকট হয়ে উঠে এসেছে ‘সেভ দা চিলড্রেন’-এর সমীক্ষায় অংশ নেওয়া বেশ কিছু কিশোরের কথা থেকে।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা এক কিশোর সমীক্ষকদের জানিয়েছে, “মেয়েরা তো শারীরিকভাবে দুর্বল। তাদের রক্ষা করার জন্য কোনও পুরুষের সবসময়ে তাদের সঙ্গে থাকা উচিত।”
মধ্য প্রদেশের একটি গ্রামের কিশোর বলেছে, “মেয়েরা রাস্তাঘাটে বেরুলে সঙ্গে সবসময়ে তার ভাইদের সঙ্গে থাকা উচিত। ভাইদেরই দায়িত্ব বোনকে রক্ষা করা।”
সমীক্ষকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আসাম রাজ্যের শহরাঞ্চলের এক কিশোর বলেছে, “মেয়েরা যদি খাটো বা ফ্যাশনের পোশাক পরে, সেজন্যই তো অনেক সময়ে পুরুষরা প্রলুব্ধ হয়ে মেয়েদের হেনস্থা করে।”
পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বলছিলেন, “বেশ কিছুদিন ধরেই এই বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছিল যে মেয়েদের সুরক্ষা-নিরাপত্তার কথা তো বলাই হচ্ছে, কিন্তু কিশোরী বা বয়:সন্ধিকালের মেয়েদের কথা চিন্তা করতে গিয়ে আমরা ওই একই বয়সের কিশোরদের ভুলে যাচ্ছি না তো? লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে আমরা সত্যিই তো কিশোরদের সমস্যাগুলোর দিকে, তাদের মনস্তত্ত্বের দিকে নজরই দিই নি। সমস্যা তো তাদেরও আছে। কারণ এই বয়সেই তো তার মধ্যে পৌরুষের ধারণা তৈরি হচ্ছে।”
“যে সমাজে, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে একটি ছেলে বড় হচ্ছে, সেটা তাকে ভাবতে শেখাচ্ছে যে একই বয়সের একটি মেয়ে তার বন্ধু নয়, যেন জয় করার মতো একটা ট্রফি। ছেলে হয়ে জন্মানোর ফলে সে যে সব বিষয়েই মেয়েদের থেকে এগিয়ে, সে যে শ্রেষ্ঠ, এই বার্তাটাই তো তার মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় নানা ভাবে।”
মিজ ঘোষের ব্যাখ্যা – “মেয়েদের ট্রফি বা জয় করার বস্তু হিসাবে মনে করে বলেই বয়:সন্ধিকালের কিশোররা নানা ধরণের যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটিয়ে সেটিকে আবার ভিডিও রেকর্ডিংও করছে। সে প্রমাণ রাখতে চাইছে যে সে কিছু জিততে পেরেছে, যাতে তার বন্ধুদের কাছে সে নিজে একটা ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারে। না হলে এত যৌন হেনস্থার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে কীভাবে!”
নারীদের প্রতি মনোভাব বদলানোর জন্য এতবছর ধরে যে এত কর্মসূচী চলছে, প্রচারণা চলছে সেগুলো কি কোনো কাজে আসছে না?
শাশ্বতী ঘোষ বলছিলেন, “সব নিশ্চয়ই বৃথা যায় নি। সমাজের একটা বড় অংশের মনোভাব পাল্টিয়েছে বলেই আগের থেকে যৌন অপরাধের অভিযোগ অনেক বেশী থানায় দায়ের হচ্ছে। তবে ঠিকই, মেয়েদের জন্য যত ভাবনা-চিন্তা হয়েছে, ততটা ওই এক বয়সী কিশোরদের জন্য করা হয় নি।”
সেভ দা চিলড্রেন-এর চিত্তপ্রিয় সাধু বলছিলেন, সেই জন্যই এই সমীক্ষায় তারা শুধু কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলেই ক্ষান্ত থাকেন নি। কথা বলেছেন একই বয়সের কিশোর আর অভিভাবকদের সঙ্গে।
BBC