স্বপ্নপূরণের আশায় ফ্রান্স

প্রতিভার অভাব নেই দলে। এতটাই যে কাকে রেখে কাকে দলে নেবেন, সেটাই মধুর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দিদিয়ের দেশমের জন্য। রাশিয়া বিশ্বকাপের দলে তিনি নিতে পারেননি আলেকজান্দ্রে লাকাজাতে, অ্যান্থনি মার্শিয়াল, কিংসলে কোম্যানের মতো খেলোয়াড়দের। এমন যে দলের শক্তি, তাদের তো ফেভারিট মানতেই হয়। কোচের কাজটাও তাই কঠিন বটে। দেশম অবশ্য মনে করছেন, মূল কাজটা আসলে মানিয়ে নেওয়া। আর সেটা করতে পারলেই সাফল্য পাওয়া সম্ভব।
‘কোচের মূল কাজটা হলো মানিয়ে নেওয়া। আমিও তা-ই করি, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি’, বলেছেন দেশম। তবে তাঁর চোখে আসলে মূল নায়ক খেলোয়াড়রাই, ‘আমার ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে আমি খেলোয়াড়দের দলে নিই, কারণ ওরাই তো আসল কাজটা করে। প্রতিটি অভিজ্ঞতা, সেটা ভালো হোক বা খারাপ, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রয়োজন হলে আমাকে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়।’
দেশমের কাজটাকে আরো কঠিন করে তুলেছে আসলে ফ্রান্স দলের বহুজাতিক চরিত্র। কিলিয়ান এমবাপ্পে, আঁতোয়ান গ্রিজমান, স্যামুয়েল উমতিতি, রাফায়েল ভারানে, পল পগবার মতো তারকারা শুধু ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্রতিনিধিত্বই করেন না, তাঁরা খেলেনও ভিন্ন ভিন্ন দেশের ক্লাবে, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে। তাঁদের এক সুতোয় গাঁথার কাজটাই সবচেয়ে কঠিন। কিন্তু দেশমের জন্য সেটা খুব বেশি কঠিন হওয়ার কথা নয়। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি, ওই দলটাও ছিল আক্ষরিক অর্থেই বহুজাতিক। লিলিয়ান থুরাম, মার্সেল দেসাই, থিয়েরি অঁরি, ইউরি জোরকায়েফ, এমনকি দলের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার জিনেদিন জিদান পর্যন্ত ছিলেন অভিবাসী এবং তিনি কখনো লুকানোর চেষ্টা করেননি তাঁর অভিবাসী পরিচয়। তখনকার কোচ আইমে জ্যাক ওই দলটাকে এক সুতোয় বেঁধেই পেয়েছিলেন ফ্রান্সের ইতিহাসের সেরা সাফল্য। দেশম নিজে খুব কাছে থেকে দেখেছেন সেটা, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টাকে এমন গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শিখেছেন তিনি!
দেশমের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আছে আরো অনেক কিছুই। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ দেখেছেন তিনি, ২০০০ সালের ইউরো জয়ের স্মৃতিও আছে তাঁর। দলের সঙ্গে থেকে না হোক, ২০০২ বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় আর ২০১০ বিশ্বকাপের খেলোয়াড় বিদ্রোহ, সবই ঘটেছে তাঁর চোখের সামনে। ভালো-খারাপ দুই রকমের অভিজ্ঞতাই আছে তাঁর।
একটা সময় ছিল, যখন বলা হতো ভাগ্যটা নাকি সব সময় পক্ষে থাকে দেশমের। তবে ফ্রান্স দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সেটা খুব একটা পক্ষে থাকছে না তাঁর। প্রতিভার ছড়াছড়ি থেকে দল বেছে নিতে গিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, কথা উঠছে তাঁর কৌশল নিয়েও। দুই বছর আগে নিজেদের মাঠে ইউরোর ফাইনালে হারটার কথাই ধরা যাক—গ্রিয়েজমান, পায়েত, জিরদদের নিয়ে দুর্দান্ত আক্রমণভাগ হাতে রেখেও তিনি গ্রহণ করেছিলেন রক্ষণাত্মক কৌশল। ফল, পর্তুগালের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ।
রাশিয়ায় সেই স্বপ্নপূরণের সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু সেটা করতে হলে যে দলে একজন জাদুকরের দরকার! ঐতিহাসিকভাবে সফল ফ্রান্স দলে এ রকম একজন নেতা ছিলেন সব সময়। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া দলে যেমন ছিলেন রেমন্ড কোপা, আশির দশকে দুবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠা দলের প্রাণভোমরা ছিলেন মিশেল প্লাতিনি, আর ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সব সাফল্যের সারথী ছিলেন জিদান। এখনকার ফ্রান্স দলে সেটা হওয়ার সুযোগ আছে পগবার, কিন্তু জুভেন্টাসের পগবাকে ফ্রান্স কিংবা তাঁর এখনকার দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেও ঠিক সেই রূপে দেখা যাচ্ছে না। দেশম কিন্তু বলছেন উল্টো কথা, ‘পগবা একা কিছু করতে পারবে না। সাফল্য পেতে হলে দলের সব সদস্যকেই নিজের দায়িত্বটা পালন করতে হবে ঠিকমতো।’
পগবার পাশাপাশি সম্প্রতি সমালোচনার শিকার হওয়া দলের অন্য দুই সদস্য গোলরক্ষক হুগো লরি আর স্ট্রাইকার জিরদের পাশেও থাকছেন তিনি। বিশ্বকাপের আগে সর্বশেষ দুটি প্রস্তুতি ম্যাচেই চোখে পড়ার মতো ভুল করেছেন লরি, কিন্তু দেশম তাঁকে আগলে রাখছেন, ‘এমন ম্যাচে দারুণ চাপে থাকতে হয়। আর গোলরক্ষকদের কাজটাও এমন যে প্রশংসা পাওয়া যায় না, শুধু সমালোচনাই শুনতে হয়। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি, ওর ওপর আস্থা আছে আমার।’
মার্শিয়াল-লাকাজাতেরা না থাকলেও নাবিল ফেকির-উসমান দেম্বেলেরা আছেন বলে চাপ আছে জিরদের ওপর। তবু অভিজ্ঞ এই স্ট্রাইকারের ওপরই আস্থা রাখতে চান দেশম, ‘জিরদ কিন্তু অনেক গোল করে। সেগুলো হয়তো সুন্দর হয় না, কিন্তু গোল তো।’
এই আস্থার প্রতিদান জিরদ-লরিরা দিতে পারলেই কেবল দেশমকে ধরা দেবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। টাইমস নিউজ নেটওয়ার্ক