প্রাণের ৭১

মিয়ানমার সব মানতে চায়, কেবল রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব বাদে। : রয়টার্স।

পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করাকেই রাখাইন সংকট সমাধানের পথ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে। তবে রয়টার্সের এক বিশেষ অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, মিয়ানমার আনান কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজি থাকলেও সহসা নাগরিকত্ব নিশ্চিতের পদক্ষেপ শুরু করছে না। নাগরিকত্ব নিশ্চিতের পথে ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনকে বাধা হিসেবে শনাক্ত করেছিল আনান কমিশন। আইনটি সংশোধনের আবশ্যিকতা তুলে ধরা হয়েছিল কমিশনের প্রতিবেদেন। তবে রয়টার্সের বিশেষ অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, গত ৮ জুন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী উয়িন মিয়াত পশ্চিমা কূটনীতিকদের জানিয়ে দিয়েছেন, সহসা নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই।
A
A
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এতে মিয়ানমারে বসবাসকারীদের Citizen, Associate এবং Naturalized পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এমনকি দেশটির সরকার তাদের প্রাচীন নৃগোষ্ঠী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়নি। ১৮২৩ সালের পরে আগতদের Associate আর ১৯৮২ সালে নতুনভাবে দরখাস্তকারীদের Naturalized বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ওই আইনের ৪ নম্বর প্রভিশনে আরও শর্ত দেওয়া হয়, কোনও জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রের নাগরিক কি না, তা আইন-আদালত নয়; নির্ধারণ করবে সরকারের নীতি-নির্ধারণী সংস্থা ‘কাউন্সিল অব স্টেট’। এ আইনের কারণে রোহিঙ্গারা ভাসমান জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হয়।
রাখাইন সংকট অনুসন্ধানে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি’র উদ্যোগে গঠিত কফি আনানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিশন ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা প্রকাশ করে। এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ‘যদি স্থানীয় জনগণের বৈধ অভিযোগগুলো উপেক্ষা করা হয়, তবে তারা জঙ্গি সংগঠনগুলোতে যোগ দেওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে।’ রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত না করা হলে এবং এ সম্প্রদায়টি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক থেকে গেলে উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য জঙ্গিবাদের উর্বর ঘাঁটিতে পরিণত হবে বলেও আশঙ্কা জানায় কমিশন। নাগরিকত্ব নিশ্চিত্বের বাধা দূর করতে ৮২’র নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের আবশ্যিকতা তুলে ধরা হয়। তবে গত ৮ জুন কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উয়িন মিয়াত আয়ে পশ্চিমা কূটনীতিক, বিশ্লেষক ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সদস্যদের ৮৮টি সুপারিশের মধ্যে ৮টি পূরণে অপারগতার কথা জানান। এর একটি হলো ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন। মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বৈঠকে দাবি করেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ওই সুপারিশগুলো সমস্যাপূর্ণ এবং সহসা সেগুলো পূরণ করা সম্ভব নয়।
ডেনমার্কের বৈঠকে ছিলেন মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাং তুন। তিনি রয়টার্সকে জানিয়েছেন, আনান কমিশনের সুপারিশ তারা ততটুকুই বাস্তবায়ন করছেন যতটুকু তাদের পক্ষে সম্ভব। রয়টার্সের এক ইমেইলের জবাবে তিনি দাবি করেন, ‘১০ মাসের মধ্যে ৮০টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।’ আর যেগুলো এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি সেগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বৈঠবকে উপস্থিত আরেক প্রতিনিধি বলেন, রাজনৈতিক ও বাস্তবিক পার্থক্যের কারণে আটটি সুপারিশ বাস্তবায়ন করছে না ইয়াঙ্গুন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বরাত দিয়ে ওই কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ‘তিনি (মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী) স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হচ্ছে না।’উয়িন মিয়াত আয়ে অবশ্য সরাসরি বলেননি যে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে না তারা। তিনি বলেছেন, এ সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। নাগরিকত্ব নিশ্চিতে স্বাধীন পর্যালোচনা কমিটি তৈরি, সাম্প্রদায়িক ও সুশীল নেতাদের ক্ষমতায়ন ও সরকারি কার্যক্রম তদারকি ও পর্যালোচনার জন্য কমিটি গঠনের কথাও জানিয়েছেন তিনি। তবে বৈঠকে থাকা মিয়ানমারের ওই প্রতিনিধি বলেন, ‘কূটনৈতিক ভাষায় বলতে গেলে যখন আপনি বলেন যে জটিলতা আছে তার মানে হচ্ছে আপনি এটা করতে চান না বা প্রত্যাখ্যান করছেন। আমি এমনটাই মনে করি।’
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈঠকে উপস্থিত থাকা পাঁচ সূত্রের কেউই তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। কারণ বৈঠকে আলোচনার বিষয়বস্তুগুলো গোপন রাখতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অনুরোধ জানিয়েছিল। ঘটনা সম্পর্কে জানতে মন্ত্রী উয়িন মিয়াত আয়ে ও সরকারের মুখপাত্র জ হটেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সাড়া পায়নি রয়টার্স।
চলতি বছর জানুয়ারিতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুসারে আগামী দুই বছরের মধ্যে সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তব পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার।

/এমএইচ/এফইউ/বিএ/






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*