প্রাণের ৭১

যেভাবে বিশ্বের শীর্ষ ধনী হলেন জেফ বেজুস!

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী লোক কে – এ প্রশ্ন করা হলে কিছুদিন আগেও উত্তর হতো: মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। কিন্তু এখন আর তা নয।
বিশ্বের শীর্ষ ধনী এখন অনলাইনে কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস।
তার সম্পদের পরিমাণ এখন ১৫০ বিলিয়ন বা ১৫ হাজার কোটি ডলার। তার থেকে অনেকটা পিছিয়ে দ্বিতীয় স্থানে বিল গেটস, যার সম্পদের পরিমাণ ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি অ্যামাজন এক সময় ছিল অনলাইনে পুরোনো বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান। আর এখন তা শিগগীরই হতে যাচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ট্রিলিয়ন-ডলার কোম্পানি – অর্থাৎ তার মূল্য হবে এক লক্ষ কোটি ডলার।
অ্যামাজনে কেনা যায় না – বোধ হয় সারা দুনিয়ায় এমন কিছুই এখন নেই। আপনার পোষা বেড়ালের খাবার থেকে শুরু করে বহুমূ্ল্য ক্যাভিয়ার পর্যন্ত সব কিছুই কেনা যায় অ্যামাজনে – বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে। শুধু তাই নয় অ্যামাজনের আছে স্ট্রিমিং টিভি, এমন কি নিজস্ব এ্যারোস্পেস কোম্পানি – যাতে শিগগীরই মহাশূন্য ভ্রমণের টিকিট পাওয়া যাবে।
কি করে এত ধনী হলেন তিনি?
তিনি যেন নিজেই জানতেন তার ভবিষ্যৎ
তার গল্প শুনলে মনে হয় যেন জেফ বেজোসের হাতে একটা ক্রিস্টাল বল ছিল – যাতে তিনি তার নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন।
মাত্র দু’দশক আগেও তিনি ছিলেন সাধারণ এক উদ্যোক্তা।
কিন্তু তিনি দেখতে পেয়েছিলেন এমন এক যুগ আসছে – যখন কম্পিউটারের এক ক্লিকে যে কোন জিনিস কেনা যাবে, শপিং মলের জনপ্রিয়তা কমে যাবে, দোকানগুলো ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য নানা রকমের ‘অফার’ দিতে বাধ্য হবে।
বেশ কয়েক বছর আগে তার হাইস্কুলের বান্ধবী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তার সব সময়ই মনে হতো জেফ বেজোস একদিন বিরাট ধনশালী হবেন।
তার কথা ছিল: “ভাববেন না যে আমার এটা মনে হতো তার টাকার জন্য – বরং টাকা দিয়ে কি করা হবে, কি ভাবে ভবিষ্যৎকে বদলে দেয়া যাবে – সেটাই ছিল তার বৈশিষ্ট্য।”
জেফ বেজোসের ছিল সেই উচ্চাভিলাষ, অন্তর্দৃষ্টি আর ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারার ক্ষমতা – যা হয়তো সবার থাকে না। এবং সেটা বোঝা গিয়েছিল কয়েক দশক আগেই।
তার জন্ম হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, তখনও তার বাবা-মার বয়েস ১৯ পেরোয় নি। খুব দ্রুতই তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
এর পর তিনি বড় হন তার মা জ্যাকি আর দ্বিতীয় স্বামী মাইক বেজোসের ঘরে।
এই মাইক বেজোস তখন চাকরি করতেন এক্সন কোম্পানিতে। তার আসল দেশ ছিল কিউবায়, কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসার পর তিনি পালিয়ে আমেরিকায় চলে আসেন।
জেফরি বেজোসের এক জীবনী লিখেছেন ব্র্যাড স্টোন। তাতে বলা হয়, ছোট্ট বয়েস থেকেই জেফের আগ্রহ দেখা যায় বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংএর দিকে। তিন বছর বয়েসেই তিনি স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে তার খেলনা খুলে ফেলতে শিখেছিলেন।
জেফ বেজোস যখন হাইস্কুলে পড়েন তখন তার গ্রাজুয়েশন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, তিনি এমন এক অনাগত সময়কে দেখতে পাচ্ছেন – যথন মানুষ মহাশূন্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করবে।
জেফ বেজোস এর পর ইঞ্জিনিয়ারিং আর কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়েন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারও পর নিউ ইয়র্কে গিয়ে চাকরি করেন কয়েকটি ফিনান্স কোম্পানিতে।
তার স্ত্রী ম্যাকেঞ্জির সাথে এসময়ই পরিচয় হয় তার।
বেজোসের বয়স যখন ৩০, তখন একটা পরিসংখ্যান চোখে পড়ে তার যাতে বলা হয়েছিল ইন্টারনেটের দ্রুত বৃদ্ধির কথা। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন – নিজেই কিছু একটা করবেন।
বেজোস চলে গেলেন আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তের শহর সিয়াটলে।
তার নিজের জমানো কিছু টাকা, আর পরিবারের কিছু সাহায্য – সব মিলিয়ে এক লাখ ডলারের কিছু বেশি অর্থ, এই ছিল তার বিনিয়োগ।
সাইবারকমার্স কিং
তিনি ১৯৯৫ অ্যামাজন নামে একটা কোম্পানি চালু করলেন – অনলাইনে পুরোনো বই বিক্রির।
মাত্র এক মাসের মধ্যে তার ব্যবসা হু হু করে বাড়তে লাগলো।
এক মাসের মধ্যে অ্যামাজন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সবগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ৪৫টি দেশে অর্ডার পাঠালো। পাঁচ বছর পর অ্যামাজনের ক্রেতার এ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়ালো ১ কোটি ৭০ লাখে।
বিক্রি শুরুতে ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ডলার, আজ পাঁচ বছর পর তা দাঁড়ালো ১৬০ কোটি ডলারে।
বড় বড় কোম্পানি আমাজনের দরজায় ছুটে আসতে শুরু করলো। ১৯৯৭ সালে অ্যামাজন পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত হলো, আর অর্থ উঠলো ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
বয়েস ৩৫ হবার আগেই মি. বেজোস হয়ে গেলেন পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের একজন।
১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে আখ্যা দিলো ‘কিং অব সাইবার-কমার্স’ আর মনোনীত করলেঅ পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়স্ক পিপল অব দি ইয়ারের একজন হিসেবে।
কি ছিল আমাজনের ব্যবসার কৌশল?
জেফ বেজোসের কৌশল ছিল, তিনি অর্থ আয় করার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পিছপা হননি। অ্যামাজনে পণ্য বিক্রির জন্য তিনি ফ্রি শিপিং সুবিধা দিয়েছেন, দাম কম রেখেছেন ২৩ বছরের মধ্যে ১০ বছর ধরে – বার্ষিক লাভের কথা না ভেবে।
কিন্ডল ই-বুক রিডারের মতো যন্ত্র তৈরির জন্য বছরের পর বছর সময় ব্যয় করেছেন।
অন্যদিকে আবার অ্যামাজন যেখানে যেভাবে সম্ভব – টাকা বাঁচিয়েছেও। অ্যামাজনের হেড অফিসে কর্মীদের গাড়ি পার্ক করার জন্য পয়সা দিতে হয়েছে। সরবরাহকারীদের সঙ্গে লড়তে হয়েছে, ওয়্যারহাউজে শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে গেছে, এবং যেখানে যতটা সম্ভব – ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে।
এ বছর জুন মাসে অ্যামাজন পণ্য বিক্রি করেছে ৫৩০ কোটি ডলারের। প্রথম তিন মাসে লাভ করেছে ২৫০ কোটি ডলারের।
অ্যামাজনে চাকরি করেন ৫ লাখ ৭৫ হাজার লোক – যা ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গের জনসংখ্যার প্রায় সমান।
আমাজনে যারা পণ্য বিক্রি করেন তাদের জন্য পণ্য আনা নেয়া, ঋণ, বিক্রির প্ল্যাটফর্ম দেয়া হচ্ছে, পাশাপাশি এর ‘ক্লাউড কম্পিউটিং বিভাগ’ অসংখ্য বড় বড় কোম্পানির জন্য অনলাইন ডেটা স্টোরেজ সুবিধা দিচ্ছে – যা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম।
গত বছর তারা খাদ্যপণ্যের কোম্পানি গোল ফুডস কিনে নিয়েছে, অনলাইন ফার্মেসি কিনেছে। আরো নানা রকম চুক্তির আলোচন চলছে। এক কথায় অ্যামাজনের নতুন নতুন উদ্যোগ হাতে নেবার উৎসাহ এতটুকু কমে নি।
জেফ বেজোস নিজে এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার মালিক।
অন্য অনেক ধনীর মতোই মি বেজোসের শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার সমালোচকদের একজন।
তার সমালোচকদের মোকাবিলা করতে এখন লবিইস্ট নিয়োগের পেছনে খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে অ্যামাজন।
অনেকে বলেন, অন্য ধনীদের তুলনায় জেফ বেজোসের দাতব্য কর্মকান্ড অনেক কম।
সেকারণে এখন দাতব্য কর্মকান্ডও বাড়াতে যাচ্ছেন তিনি। শিগগীরই নাকি এ নিয়ে একটি ‘ঘোষণা’ আসতে যাচ্ছে।



(পরবর্তি সংবাদ) »



মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*