আজ সবার পরীক্ষা তিন সিটিতে
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সক্ষমতা যাচাই ও আস্থা অর্জনের সর্বশেষ পরীক্ষা আজ সোমবার। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ইসি কতটা আস্থা অর্জন করতে পারছে তার প্রকাশ ঘটবে আজ রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলেরও আগ্রহ যথেষ্ট। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এর মধ্য দিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তাও অনেকটা যাচাই হয়ে যাবে। নির্বাচন কর্মকর্তারা একে জাতীয় নির্বাচনের প্রি-টেস্ট বা প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা বলেও মন্তব্য করছেন। এ নির্বাচনের পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ পুরোদমে শুরু করতে যাচ্ছে ইসি।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম গত বুধবার বলেছেন, ‘গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচন গুড হয়েছে। আর রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে বেটার নির্বাচন হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে পর্যায়ক্রমে যেন আরো ভালো নির্বাচন হয়।’ নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেছিলেন তিনি।
অন্যদিকে বিএনপির দাবি, তিন সিটিতে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির আন্তরিকতা থাকলেও পুলিশ প্রশাসন তাদের কথা শুনছে না। তারা বাড়াবাড়ি করছে। ইসির কঠোর নির্দেশনা ও হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি ও গ্রেপ্তার করছে। এই তিন সিটির নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে না পারলে নির্বাচনী ব্যবস্থা হুমকির
সম্মুখীন হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএনপি। গতকাল রবিবার দুপুর ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির প্রতিনিধিদলের প্রধান দলটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের কাছে এই আশঙ্কা ও অভিযোগের কথা বলেন।
খোকন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও সুষ্ঠু ভোট করাতে পারেনি। পুলিশ প্রশাসন নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। ওই দুই সিটিতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নেওয়া হলে তারা কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সাহস পেত না।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, তিন সিটিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে, মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন।
মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান, তাঁরা দলের পক্ষে থেকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত আইন-শৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের শাস্তির ব্যবস্থা, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মী ও পোলিং এজেন্টদের গ্রেপ্তার না করা, ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশাধিকার দেওয়াসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে নির্বাচনী পরিবেশ না থাকার অভিযোগের সঙ্গে একমত নয় ইসি। তাদের মূল্যায়ন, রাজশাহীতে ককটেল বিস্ফোরণ ছাড়া এ পর্যন্ত অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে।
এর আগে খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পরিবেশও শান্তিপূর্ণ ছিল। ওই দুই নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ ও সুষুমভাবে হয়েছে বলে ইসির পক্ষে দাবি করা হলেও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ওই নির্বাচনকে নতুন মডেলের ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত করেন।
ওই দুই সিটির নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের কাছ থেকে পাওয়া মন্তব্যেও ভিন্নতা দেখা যায়। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এ নির্বাচন আইনানুগ এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সঠিক ডেফিনেশন নেই। কিন্তু আইন নির্ধারিত। তাই আমরা আইনানুগ নির্বাচনের জন্য সব কাজই করি। আমরা ধরেই নিই, আইনানুগ নির্বাচন হলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সুতরাং এখানে আইনানুগই মুখ্য।’
পরে নির্বাচন কমিশনার মাহাবুব তালুকদার বলেন, ‘আমরা অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলো চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে পথ চলতে চাই। খুলনা ও গাজীপুরে যে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে যেসব ভুল-ভ্রান্তি ছিল সেগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি। আগামীতে যে তিন সিটিতে নির্বাচন রয়েছে সেখানে যেন ওই সব ভুলের এবং যেসব অনিয়ম হয়েছে সেসব অনিয়মের পুনরাবৃত্তি না হয় এ বিষয়টি আমরা নজরে রাখব।’
তদারকি ও পর্যবেক্ষণ : জানা যায়, তিন নির্বাচন কমিশনার আলাদাভাবে তিনটি সিটির আজকের নির্বাচন তদারকি করছেন। তাঁদের মধ্যে মাহবুব তালুকদার বরিশালের, ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী রাজশাহীর এবং রফিকুল ইসলাম সিলেট সিটির নির্বাচন তদারকির দায়িত্বে আছেন। এ ছাড়া এই তিন সিটির নির্বাচন পর্যবেক্ষণে থাকছেন ইসির নিজস্ব ২৯ জন পর্যবেক্ষক। প্রতি তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে পর্যবেক্ষক দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁদের সঙ্গে থাকছেন একজন প্রধান ও একজন উপসমন্বয়ক।
ঢাকায় নির্বাচন ভবনেও থাকছে আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক বিশেষ সেল। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের নেতৃত্বে এ সেলের দায়িত্ব পালন করবেন সব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরা।
তিন সিটির নির্বাচন সরেজমিনে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে যুক্তরাষ্ট্র এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ইসি থেকে ১৯ জনের নামে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কার্ড ইস্যুর জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মার্কিন দূতাবাস থেকে ছয়জন এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে থাকছেন। তাঁদের মধ্যে রাজশাহীতে চারজন এবং বরিশাল ও সিলেট সিটিতে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) ৯ প্রতিনিধি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। ইউএসএআইডির চারজন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাজ্যের পক্ষে ঢাকায় দেশটির হাইকমিশনের রাজনৈতিক বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার নেতৃত্বে ইলেকশন অবজারভার টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা মাঠে থাকার পাশাপাশি ঢাকায় বসেও প্রযুক্তিসহ নানা মাধ্যমে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপান, কানাডা, জার্মানির কূটনীতিকরাও নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।
তিন সিটি এলাকায় আজ ছুটি : ভোটগ্রহণ উপলক্ষে আজ তিন সিটি এলাকায় ছুটি থাকছে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা চলবে ভোটগ্রহণ। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হবে তিন সিটির মোট ১৫টি কেন্দ্রে। এর মধ্যে বরিশালে ১১টি এবং রাজশাহী ও সিলেটে দুটি করে কেন্দ্র থাকছে। বরিশালে ২৫টি কেন্দ্র থেকে ট্যাবের মাধ্যমে নির্বাচন পরিস্থিতি ও ফল তাত্ক্ষণিকভাবে জানানো হবে ইসিকে।
প্রার্থী, ভোটার ও ভোটকেন্দ্র : ৩০টি সাধারণ ও ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের রাজশাহী সিটিতে মোট ভোটার তিন লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ জন, যার মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৫৬ হাজার ৮৫ এবং নারী এক লাখ ৬২ হাজার ৫৩ জন। ভোটকেন্দ্র ১৩৮ এবং ভোটকক্ষ এক হাজার ২৬টি। এ সিটিতে মেয়র পদে প্রার্থী পাঁচজন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, বিএনপির মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির মো. হাবিবুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. শফিকুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র মো. মুরাদ মোর্শেদ। ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন ১৬০ জন। আর ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী ৫২ জন।
বরিশাল সিটির ৩০ ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্র ১২৩টি এবং ভোটকক্ষ ৭৫০টি। মোট ভোটার দুই লাখ ৪২ হাজার ১৬৬, যার মধ্যে পুরুষ এক লাখ ২১ হাজার ৪৩৬ এবং নারী এক লাখ ২০ হাজার ৭৩০ জন। মেয়র পদে লড়ছেন ছয়জন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, বিএনপির মো. মজিবর রহমান সরওয়ার, জাতীয় পার্টির মো. ইকবাল হোসেন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের মনীষা চক্রবর্তী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির আবুল কালাম আজাদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ওবাইদুর রহমান (মাহাবুব) ও স্বতন্ত্র বশির আহমেদ ঝুনু। ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন ৯৪ জন। আর ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী ৩৫ জন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্র ১৩৪টি এবং ভোটকক্ষ ৯২৬টি। মোট ভোটার তিন লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন, যার মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ এবং নারী এক লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন। এ সিটিতে মেয়র পদে প্রার্থী সাতজন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন খান, বাসদের মো. আবু জাফর এবং স্বতন্ত্র এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, মো. এহছানুল হক তাহের ও বিএনপির বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত মো. বদরুজ্জামান সেলিম। এ ছাড়া ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ১২৭ জন। ৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী ৬২ জন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় যারা : তিন সিটিতেই সাধারণ কেন্দ্রে আনসারসহ ২২ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ২৪ জন নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করবে। রাজশাহী ও বরিশালে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে মোবাইল ফোর্সের ৩০টি দল, স্ট্রাইকিং ফোর্সের ১০টি দল; প্রতিটি ওয়ার্ডে র্যাবের একটি করে দল এবং প্রতি দুই ওয়ার্ডে একটি করে মোট ১৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থাকছে। সিলেট সিটিতে থাকছে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে মোবাইল ফোর্সের ২৭টি ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের ১০টি দল, র্যাবের ২৮টি দল এবং ১৪ প্লাটুন বিজিবি।