প্রাণের ৭১

আজ মন্ত্রিসভা বৈঠকে উঠছে ‘সরকারি চাকুরি আইন

অনুমতি লাগবে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে

ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ করার আগে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করতে হলে সরকারের অনুমতি লাগবে। এ বিধান রেখে ‘সরকারি চাকুরি আইন’-এর খসড়া করা হয়েছে। এই খসড়াটি অনুমোদনের জন্য আজ মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে এ বৈঠক হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত সরকারি চাকরি আইনে বিনা অনুমতিতে গ্রেপ্তারসহ বিভিন্নভাবে সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারি দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ, অবমাননা, মানহানি বা অন্য কোনো মামলা করা হলে তিনি সরকারের আইন কর্মকর্তার সহায়তায় বা নিজে মামলা পরিচালনা করতে পারবেন। এই মামলা পরিচালনায় ব্যয় করা অর্থ তিনি সরকারের কাছ থেকে পাবেন। তবে দুর্নীতির অভিযোগে বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে যে মামলা হবে তার খরচ সরকার বহন করবে না। কোনো মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে সরকার অভিযোগ দায়েরকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও এত দিন সরকারি কর্মচারীদের জন্য কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। বিভিন্ন বিধিবিধান দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার ‘সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে বিভিন্ন সভা করে। ২০০৫ সালে ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ নামে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরির উদ্যোগ নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। কয়েকটি বৈঠক করলেও কোনো পূর্ণাঙ্গ খসড়া তৈরি করতে পারেনি তারা। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটির একটি খসড়া তৈরি করলেও নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আর্থিক সহায়তায় ‘সিভিল সার্ভিস আইন’-এর খসড়া চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা খসড়া যুগোপযোগী করতে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) তৎকালীন যুগ্ম সচিব (বিধি) মো. ফিরোজ মিয়ার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি উপকমিটি করা হয়। ২০১১ সালের মার্চে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আইনের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারে মতভেদ দেখা দেয়। বিষয়টি সুরাহা করতে প্রকৃচিসহ (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে সব ক্যাডার ও কর্মচারী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে খসড়া নিয়ে সংলাপ করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১২ সালে রাজধানীর একটি হোটেলে মতবিনিময়সভা হয়। সেখানে প্রস্তাবিত খসড়ায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সচিব নিয়োগের বিধান থাকার তীব্র বিরোধিতা করেন সব ক্যাডার কর্মকর্তা। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ঘোষণা দেন যে ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ নয়, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য একসঙ্গে ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ প্রণয়ন করা হবে। নানা প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৪ সালের ২১ মে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই বছরের ৩ আগস্ট খসড়াটি অনুমোদন দেয় প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটি। এর প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ সময় কিছু পর্যবেক্ষণও দেওয়া হয়। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে কিছু পর্যবেক্ষণসহ আবার খসড়াটি ফেরত পাঠানো হয়। নানা কমিটি, সাবকমিটির হাত ঘুরে খসড়াটি আজ আবার মন্ত্রিসভায় যাচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুরুতে আইনটি একটি পূর্ণাঙ্গ আইনের আদলে খসড়া করা হয়েছিল। কিন্তু যতই দিন গেছে ততই খসড়াটি ছেঁটে ছোট করা হয়েছে। শুরুতে খসড়ায় অন্যতম বিধান ছিল সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরই পদোন্নতি পাওয়ার জন্য লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। তরুণ কর্মকর্তাদের প্রতিবাদের মুখে সেই ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। খসড়ায় সরকারের বিশেষ পদ উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদের ১০ শতাংশ সরকারি কর্মচারীদের বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও অপরিহার্যতা বিবেচনা করে এসব পদের ১০ শতাংশ সাধারণ নাগরিকদের মধ্য থেকে নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছিল। এই ধারাটিও বাদ দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তাদের আপত্তির মুখেই। তাঁরা এই ধারাটি সরাসরি আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে চান না। তাঁদের যুক্তি—এসংক্রান্ত বিধান রাষ্ট্রপতির বিশেষ এখতিয়ারের মধ্যেই রয়েছে।

১৯৯২ সালে যখন আইনটি খসড়া শুরু হয় তখন নাম ছিল ‘সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট’। এরপর সেটি ‘সিভিল সার্ভিস আইন’-এ রূপান্তরিত হয়। এরপর নাম দেওয়া হয় ‘সরকারি কর্মচারী আইন’। কর্মচারী শব্দটিতেও আপত্তি ক্যাডার কর্মকর্তাদের। শেষ পর্যন্ত আইনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সরকারি চাকুরি আইন’।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*