প্রাণের ৭১

সিন’হার বইয়ের আংশিক অনূবাদ,ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশে অশ্লিলতা–বইটি’র ঐতিহাসিক মূল্য হারাবে৷রুহুল আমিন মজুমদার৷৷

অনুবাদঃ–“সব কিছু মিলে এ সময় আমি মানসিকভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়লাম। জাপানের এক কনফারেন্সে যাওয়ার প্রোগ্রাম আগে থেকে ঠিক করা ছিলো। চিন্তা করলাম জাপানে ঐ কনফারেন্সের আগে কানাডায় গিয়ে ছোট মেয়ের সাথে কয়েকদিন কাটালে হয়তো ভালো লাগবে। তবে মনে মনে ভাবছিলাম, জাপানের কনফারেন্সে হয়তো যাবো না।
কানাডায় পৌছার পরদিন ভারতের দ্য হিন্দু এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাগুলোতে খবর প্রকাশ হলো, তারা সরকারের সাথে আমার ঝামেলার কথা বিস্তারিত লিখেছে। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবেও এখন খবর ছড়িয়ে গেলো।
ভেবে দেখলাম, সরকার যে কোন উপায়ে বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই ছাড়বে। আমি প্রধান বিচারপতির পদে থাকার অর্থ হচ্ছে সরকারের এসব কাজকর্ম কোনভাবেই বন্ধ হবে না। এরকম চলতে থাকলে আমি আমার দায়িত্বও ঠিকমতো পালন করতে পারবো না। একা আমাকে টার্গেট করেই প্রধানমন্ত্রী নোংরা ভাষায় বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তার সাথে যোগ দিয়েছে তার দলের মন্ত্রী এমপি নেতারা সবাই।
দুইজন বিচারপতিকে তিনি ম্যানেজ করার পরও আমি তাদের মত বদলে ফেলেছি এ অপমান শেখ হাসিনা ভুলতে পারছেন না। বাংলাদেশে তার নিরংকুশ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি কারো নেই। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা বলা মানুষকে তিনি সহ্যও করতে পারেন না।
সুতরাং আমি ফোন করে এটর্নি জেনারেলকে বললাম, তিনি যেন প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন আমি পদত্যাগ করতে যাচ্ছি। কয়েক ঘন্টা পরেই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর ফোন আসলো। তিনি বললেন, আমি যেন পদত্যাগ না করে বরং অবসরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত ঠিকমতোই দায়িত্ব পালন করি।
তার কথায় পুরোপুরি ভরসা করতে পারলাম না, আবার এটর্নি জেনারেলকে ফোন করলাম। এটর্নি জেনারেলের সাথে কথা বলে বুঝলাম, প্রধানমন্ত্রীই গওহর রিজভীকে দায়িত্ব দিয়েছেন আমার সাথে কথা বলার জন্য। তাহলে হয়তো প্রধানমন্ত্রী এখন সবকিছু ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছেন। সম্ভবত ভারতের পত্রিকায় খবর চলে আসার কারণে তিনি বুঝেছেন যে এইসব ঘটনা তার সরকারের জন্যই ভালো না।
সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, আমি যথাসময়ে কনফারেন্সে যোগ দিতে জাপানও চলে গেলাম। আরাম করে টোকিও কনফারেন্সে বক্তৃতা দিলাম। সব মিলে আমার খুব শান্তি লাগতে থাকলো।
মহানন্দে আছি, এরমধ্যেই হঠাৎ শেষদিন বিকেলে আচমকা একটা কল আসলো। ডিজিএফআই এর অফিসার পরিচয় দিয়ে একজন আমাকে হুমকি দিলেন, দেশে ফিরে গেলে আমার সমস্যা হবে। আমি যেন অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা চলে যাই।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আমার ফোন নাম্বার তারা কিভাবে পেয়েছে? সে বললো, আমার সব গতিবিধি তাদের কড়া নজরে আছে। আমি বললাম, এভাবে ভ্রমণ করার মতো টাকাপয়সা আমার কাছে নেই। সে বললো, ডিজিএফআই সব টাকাপয়সা এবং টিকেটের ব্যবস্থা করে দেবে।
হঠাৎ করে এসব কথাবার্তায় আমি নতুন করে আবার থমকে গেলাম। তবু তাকে বললাম, আমাকে হুমকি দিয়ে লাভ নেই। আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি। তখন সে বললো, তাহলে এখন না, বরং অন্তত সাতদিন পরে যেন দেশে ফিরি। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে কেন সাতদিন দেরি করতে বলতেছে। আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মুহাম্মদ জহিরুল হকের চাকরির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে মামলার শুনানীতে আমি যেন থাকতে না পারি তাই তারা এ কাজ করতেছে।
দেশের একটা এলিট ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি কোন ধরণের সভ্যতা ভব্যতা কিংবা আইন কানুনের কোন তোয়াক্কা না করে এভাবে হুমকি দিচ্ছে, এসব কথাবার্তা আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। কিন্তু যখন বললাম, আমি তাদের কথা শুনবো না, তখন সে বললো দেশে ফেরার পথে সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে তাদের এক অফিসার আমার সাথে দেখা করবে, আমি যেন তার কথা মতো চলি। আমি এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করলাম।
সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ চাঙ্গি এয়ারপোর্টে পৌছলাম। আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় হাইকমিশনারের সাথে ছোট ক্রু কাট চুলের এক লোক ছিলো। তার পরিচয় জানতে চাইলে তখন তার সাথে কিছু কথা কাটাকাটি হলো। শেষ পর্যন্ত সে তার নাম বললো, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল নাজিমুদ্দৌলা। তার কণ্ঠ শুনে চিনে ফেললাম, আমাকে জাপানে এই অফিসারই ফোন করেছিলো। তার সাথে তেমন আর কোন কথাবার্তা হলো না, পরে ঢাকাগামী বিমানে উঠে পড়লাম।
রাত এগারোটায় ঢাকায় পৌছলাম। বোর্ডিং ব্রিজে আমাকে চার-পাঁচজন আর্মি অফিসার ঘিরে ধরলো। তারা তাদের গাড়ি নিয়ে আমার পেছন পেছন আমার বাসা পর্যন্ত আসলো।
আমার মাথা কাজ করছিলো না। বাসায় পৌছে স্ত্রীর বিভিন্ন কথার কোন উত্তর দিলাম না। দ্রুত কাপড় বদলে ঘুমের অষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম কিন্তু পুরো রাত ঘুমাতে পারলাম না।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার সাথে কত সুন্দর কথাবার্তা হলো, সব মিটমাট হয়ে গেলো, কিন্তু এখন আবার এমন হচ্ছে কেন? হয় ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতেছে না। অথবা প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে বলেছেন আমাকে অপমান করার জন্য। দেশ চালাচ্ছে কে? প্রধানমন্ত্রী? না ডিজিএফআই?
এরপরেই আসলো দুর্গাপুজার ছুটি। প্রতিবছর এ পাঁচদিন সাধারণত আমি গ্রামের বাড়িতে কাটাই। কিন্তু এবার দুই দিন গ্রামে থাকার পর ঢাকা ফিরে আসলাম। নবমী পুজার দিন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে দেবীর প্রার্থনা করলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে খবর বের হলো।
পরের দিন দশমীর শুভেচ্ছা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বঙ্গভবনে গেলাম। বঙ্গভবনের দরবার হলে ভারতীয় হাই কমিশনারের সাথে দেখা হলো। তার সাথে যখনই একটু কথা বলতে যাই, দুইজন আর্মি অফিসার এসে মিষ্টি খাওয়ার জন্য আমাকে টানাটানি করতে থাকে। আমি বুঝতে পারলাম তারা চাচ্ছে আমি যেন ভারতীয় হাইকমিশনারের সাথে কথা বলতে না পারি। কোন কিছু না খেয়েই আমি বঙ্গভবন থেকে চলে আসলাম।
পরদিন অফিসে রেজিস্ট্রার জেনারেল আমাকে জানালেন, বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়ার নেতৃত্বে আপিল ডিভিশনের বিচারপতিরা আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি বললাম বিকেল ৫টায় মিটিং ঠিক করতে। একটু পরে বিষয়টা নিয়ে আমার কৌতুহল হলো। আমি বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দারকে ফোন করলাম। তিনি বললেন তারা সবাই এখন ওয়াহাব মিয়ার বাসায় মিটিং করতেছে।
বুঝতে পারলাম, আমার বিরুদ্ধে কোন একটা ষড়যন্ত্র ঘোট পাকিয়ে তোলা হচ্ছে। আমি তাকে বললাম ফোনটা ওয়াহাব মিয়ার হাতে দিতে। ওয়াহাব মিয়াকে বললাম, বিকেল ৫টায় বদলে এখনি মিটিং হবে। তারা সবাই যেন আমার বাসায় চলে আসে।
দুপুর বারোটায় তারা সবাই আমার বাসায় আসলেন। মিটিং শুরু হলে আবদুল ওয়াহাব মিয়া বললেন, আগেরদিন রাতে তাদের সবাইকে প্রেসিডেন্ট ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। ওখানে বিচারপতি ঈমান আলী ছাড়া অন্য সবাই উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট তাদেরকে বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে কিছু মারাত্মক অভিযোগ এসেছে। সুতরাং তারা কেউ যেন আমার সাথে কোন আদালতে আর না বসে।
বিচারপতিরা আমাকে জানালেন, এমতাবস্থায় আমি যেন আর আদালতে না যাই। যদি যাই, তাহলে তারা আমার সাথে যোগ দেবে না। তারা সবাই মিলে আগে বসে সিদ্ধান্ত ফাইনাল করে ফেলেছেন।
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার ভাতৃপ্রতিম সহকর্মী বিচারপতিরাই এভাবে আমার সাথে বেঈমানী করতেছে। আমি যখন ছিলাম না তখন তারা সরকারের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। এটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিলো। আমাকে না জানিয়ে তারা সবাই মিলে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছে। সেদিন বিকেলে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। তিনিও আমাকে ঐ ডিনারের কথা বলেননি। দেশের সর্বোচ্চ বিচারপতিরা যখন প্রেসিডেন্ট এবং আইনমন্ত্রীর সাথে মিলে এমন কিছু করতে যাচ্ছে, এখন আসলে আর কিছু করার নেই।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি, তাও আমি জানতাম না। তাই তারা সবাই চলে যাওয়ার পর মির্জা হোসেন হায়দারকে ফোন করলাম। সে নিজেও ঠিকমতো জানেনা, প্রেসিডেন্ট কেবলমাত্র আবদুল ওয়াহাব মিয়াকে কিছু কাগজপত্র দিয়েছেন।
সে খোঁজখবর নিয়ে কয়েক ঘন্টা পর জানালো, আমি না কি কানাডায় আমার ছোট মেয়ের কাছে চার কোটি বাংলাদেশী টাকা অর্থ্যাৎ ত্রিশ হাজার কানাডিয়ান ডলার পাচার করেছি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ত্রিশ হাজার ডলারে হয় আঠারো লাখ টাকা, তাহলে আমি কিভাবে কোটি কোটি টাকা পাচার করলাম? তখন সে বললো, সে এ হিসাবটা এভাবে ভেবে দেখেনি।
পুরো ঘটনায় বিচারপতিরা কেউ ন্যায়বিচারের কোন নিদর্শন দেখাতে পারলেন না। প্রেসিডেন্টকে মনে করতাম ভদ্রলোক, তিনিও প্রধানমন্ত্রী ও ডিজিএফআই এর গোলাম প্রমাণিত হলেন। এই লোকটা আসলে একটা পঙ্গু এবং ভঙ্গুর লোক। তার নিজের শপথের প্রতিই তার কোন বিশ্বস্ততা নেই।
অক্টোবরের দুই তারিখ অফিসে কাজ করছিলাম। দুপুর বারোটার দিকে ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন দেখা করতে আসলেন। রুমে ঢুকে তিনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, চাঙ্গি এয়ারপোর্টে আমি তার অফিসারের সাথে কোন সাহসে খারাপ আচরণ করেছি? দেশের প্রধান বিচারপতির সাথে তার এই বেয়াদবী দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
তিনি বলতে থাকলেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আমার রায়ের পর বিএনপির লোকজন খুব খুশী হয়েছে। তারা মিষ্টি খেয়েছে এবং একজন আরেকজনকে এসএমএস করে লিখেছে, তারা খুব তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। আমি বললাম, এটা আমার দেখার বিষয় না।
তিনি বললেন, আমি যেন জানুয়ারীর ৩১ তারিখ পর্যন্ত ছুটি নেই। আমি বললাম, প্রধামন্ত্রীর সাথে এ নিয়ে আমার কথা হচ্ছে এবং হবে। আপনাকে এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তখন তিনি বললেন, আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে এবং তার কাছে প্রমাণ আছে। তখন আমি চিৎকার করে বললাম, এভাবে কথা বলার ক্ষমতা আপনাকে কে দিয়েছে? আপনার বেয়াদবী সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তখন তিনি আমার অফিস থেকে চলে যান।
কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম ডিজিএফআই এর সাদা পোষাকের লোকজন পুরো সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং দখলে নিয়েছে। আমার কর্মকর্তারা সবাই ভয়ে কাঁপছিলো।
পরদিন জানলাম, ডিজিএফআই এর লোকজন আইটি সেকশন থেকে তাদের চীফের আসা যাওয়ার রেকর্ডেড সব সিসিটিভি ভিডিও নিয়ে গেছে। আমার সামনে আর কোন উপায় ছিলো না। এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছুটির দরখাস্তটি পর্যন্ত ডিজিএফআই এর লোকেরাই লিখে দিলো।
দরখাস্তে সই করে বাসায় ফিরে দেখি প্রচুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরপর থেকে আমি বাসাতেই বন্দী হয়ে গেলাম। বাইরের কাউকে তারা আমার বাসায় আসতে দিচ্ছিলো না। আত্মীয়-স্বজন আসলেও তাদেরকে গেইটে আটকে রাখা হচ্ছিলো। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিলো, তাদের ছবি তুলে রাখা হচ্ছিলো। তারা আমার বাসার কাজের লোককেও একদিন মারধোর করলো।
অক্টোবরের ৩ তারিখ ডিজিএফআই চীফ আমাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করলেন আমি হাসপাতালে ভর্তি হবো কি না। আমি বললাম, আমি তো অসুস্থ না। তিনি বললেন, হাসপাতালে গেলেই ভালো করতেন।
এরপর তার নির্দেশে প্রতিদিন একজন অর্থোপেডিক ডাক্তার এবং একজন কার্ডিওলজির ডাক্তার আমার বাসায় এসে শুধু শুধু বসে থাকতেন। এদের মাঝে কার্ডিওলজিস্ট ডাক্তার সজল ব্যানার্জির নাম আমার মনে আছে। আমি কৌতুক করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তারা এমনকি একটা স্টেথোস্কোপ ছাড়াই খালি হাতে রোগী দেখার নাটক করতে এসে কেন বসে থাকেন? উত্তরে তারা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং অসহায় হাসির ভান করলেন।
একদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আমার সাথে দেখা করতে আসলেন। তাকে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বললেন, এমনিতেই এসেছেন। আমি বললাম, ভন্ডামী করবেন না। যা বলার আছে সরাসরি বলুন। তিনি বললেন, আমার খবর তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌছে দেবেন।
অক্টোবরের ৫ তারিখ রাত সাড়ে দশটায় ডিজিএফআই প্রধান আমার বাসায় আসলেন। তিনি বললেন, ডিজিএফআই টিকেট করে দেবে। ৭ বা ৮ তারিখের ভেতরেই আমাকে বিদেশ চলে যেতে হবে।
আমি গওহর রিজভীকে ফোন করলাম। তিনি পরদিন আমার বাসায় আসলেন। তাকে আমি স্মরণ করিয়ে দিলাম, তার কথা শুনেই আমি পদত্যাগ করা থেকে বিরত ছিলাম। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, প্রধানমন্ত্রীর সাথে যেন আমার একটা বৈঠক করিয়ে দেন। তিনি চলে যাওয়ার আগে বললেন, বৈঠকের ব্যবস্থা করে খুব শীঘ্রই তিনি আমাকে জানাচ্ছেন। কিন্তু পরে তিনি আর কোন যোগাযোগ করলেন না।
ওবায়দুল কাদেরও বলেছিলো প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করিয়ে দেবে, কিন্তু সে ও আর কোন খবর দিলো না।
শেষপর্যন্ত আমি বুঝতে পারলাম, আসলে ডিজিএফআই চীফের কথাই চুড়ান্ত। কারণ সে আসলে প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শেই কাজ করতেছে। কানাডায় থাকা অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী আমাকে পদত্যাগ করতে দেননি কারণ তিনি চেয়েছেন দেশে এনে আমাকে যেন এভাবেই মিলিটারি অফিসারদের হাতে অপমান করাতে পারেন। অথবা অন্য একটা সম্ভাবনা আছে যে তিনি নিজেও এসব মিলিটারি অফিসারদের সামনে অসহায়।
এক সময় দেখলাম, কেউ আর আমার টেলিফোন রিসিভ করছে না। এমন কি কারো সাথে দেখা করতে চেয়ে খবর পাঠালেও তারা আসতে সাহস পাচ্ছে না। আমার আর কিছু করার ছিলা না। তাই আমি দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম।
প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিয়ে ১৩ তারিখ অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার দিন ঠিক হলো। গেইটের বাইরে শত শত সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলো। তাদের ভীড়ের চাপে আমার গাড়ির পতাকা স্ট্যান্ড এবং সাইড মিরর ভেঙে গেলো। তারা আগেও আমার কথা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে তাই মুখে কোন কথা না বলে বরং তাদের হাতে একটা লিখিত বিবৃতি তুলে দিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম।
হাউজ এরেস্টের এ পুরো সময়টাতে ডিজিএফআই আমাকে অসুস্থ প্রমাণ করতে চাচ্ছিলো। তারা হাসপাতালে ভর্তি হতে আমাকে চাপ দিচ্ছিলো। আমি জানতাম এটা আসলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের একটা ষড়যন্ত্র ছিলো। আনিসুল হককে সংবিধান সম্পর্কে একটা গন্ডমুর্খই বলা যায়। তার দৌড় হলো কিছু অপরাধ সংক্রান্ত মামলা করা পর্যন্ত। সে চাচ্ছিলো আমাকে অসুস্থ দেখিয়ে সংবিধান অনুযায়ী আবদুল ওয়াহাব মিয়াকে দিয়ে প্রধান বিচারপতির কাজ করিয়ে নিতে।
যাত্রাপথে সিঙ্গাপুরে পৌছার পর জানতে পারলাম, আমার সম্পর্কে ভয়াবহ সব অভিযোগ নিয়ে একটা বিবৃতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আমি চলে আসার পর বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া প্রধান বিচারপতি হওয়ার লোভে নির্লজ্জ্ব চাটা শুরু করে দিলো। সে মনযোগ দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের চাকরের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করলো।
এ সময় ওয়াহাব মিয়া এতোই চাটা হয়ে গেলো পরবর্তীতে ১৮ তারিখ যখন আমার স্ত্রী অস্ট্রেলিয়া আসলো তাকে যাত্রাপথে সাহায্য করার কোন সরকারী ব্যবস্থা সে করেনি। অথচ এ সময় আমার স্ত্রী একজন প্রধান বিচারপতির স্ত্রী হিসেবে ভ্রমণ করছিলো। ট্রানজিটের সময় সিঙ্গাপুরে সবকিছু ঠেকেঠুকে করতে গিয়ে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কোনমতে ব্রিসবেন এয়ারপোর্টে পৌছে আমাকে দেখে সে কান্না শুরু করে দিলো। তার এ অসহায় অবস্থা দেখে সেখানেই আমি স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করলাম, সাংবিধানিক পদে থাকা কাউকে যেন কোনদিন আমার মতো এতো অপমান সহ্য করতে না হয়।
শুধুমাত্র একটা স্যুটকেস হাতে নিয়ে কোন টাকা পয়সা ছাড়াই আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। প্রথমে এক মাস অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে আমার বড় মেয়ের বাসায় থাকলাম। নাতিনাতনীদের সাথে সে সময়টা আমার খুব চমৎকার কেটেছে। কিন্তু এভাবে স্থায়ীভাবে থাকা যায় না। কোন আত্মসম্মান-সম্পন্ন বাবা মা’র পক্ষে তাদের মেয়ের পরিবারে অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকা সম্ভব না। সুতরাং এরপর আমি কানাডায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমাকে জানানো হয়েছিলো, বাংলাদেশে ফিরে গেলে আমাকে মেরে ফেলা হতে পারে। নভেম্বরের ৫ তারিখ কানাডায় যাওয়ার পথে মেডিক্যাল চেকআপের জন্য সিঙ্গাপুরে যাত্রাবিরতি করলাম। ৮ তারিখ কানাডায় রওনা হওয়ার কথা, সেদিন সকালে লে. কর্ণেল নাজিমুদ্দৌলা আমার সাথে যোগাযোগ করে বললো সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা যাক।
আমি ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করলাম কিন্তু কোন কাজ হলো না। তাই নাজিমুদ্দৌলার কথামতো টিকিটের তারিখ বদলে ১০ তারিখে নিয়ে গেলাম।
নাজিমুদ্দৌলাকে বললাম, তাদের কথামতো আমি পদত্যাগ করবো অথবা অবসরে চলে যাবো। তবে দুইটা শর্ত আছে। প্রথমত, আমার বিরুদ্ধে সরকারী অভিযোগগুলো ঠিক না এই মর্মে সরকারকে বিবৃতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমার বন্ধু অনিরুদ্ধ রায়কে উদ্ধার করতে হবে।
আমার ধারণা ছিলো অনিরুদ্ধকে তার ব্যবসায়ীক পার্টনার আওয়ামী মন্ত্রী-এমপিরা কিডন্যাপ করেছিলো। কিন্তু নাজিমুদ্দৌলা জানালো, অনিরুদ্ধ তাদের কাছেই কচুক্ষেত ক্যান্টনমেন্ট এলাকার আশেপাশে কোথাও আছে।
১০ তারিখ দুপুর আড়াইটার সময় নাজিমুদ্দৌলা আমার হোটেল কক্ষের দরজায় নক করে। সে জানালো, পদত্যাগপত্রে সই করার সাথে সাথে অনিরুদ্ধ রায়কে ছেড়ে দেয়া হবে। আমি বললাম, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো তুলে নিতে হবে। উত্তরে সে বললো, আমি পদত্যাগ না করলে অনিরুদ্ধকে হয়তো এমন কিছু লোকজন নিয়ে যাবে তখন আর কিছু করার থাকবে না।
তখন বাজে বিকেল ৫টা, আমার ফ্লাইট ছাড়বে রাত ৮টার সময়। সে আমাকে জানালো, হাইকমিশনার ইতিমধ্যেই বিমানবন্দরে পৌছে গেছেন সুতরাং চিন্তা করতে হবে না।
আমি অস্ট্রেলিয়াতে বসেই একটি পদত্যাগপত্র লিখে রেখেছিলাম। নাজিমুদ্দৌলার হাতে এ চিঠি দিলাম। সে চিঠিটা ফোনে তার সিনিয়র অফিসারকে পড়ে শোনালো। অফিসার চিঠিটির কিছু ভাষা পরিবর্তন করে লেখার আদেশ দিলো। কিন্তু আমি এ পদত্যাগপত্রের কোন শব্দ বদলাতে অস্বীকার করলাম।
এ সময় সে তার ফোনটি আমার হাতে দিলো, ওপাশে ছিলা অনিরুদ্ধ রায়। সে কান্না করছিলো। সে আমাকে বললো, তার একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও যেন তাদের কথামতো চিঠিতে সাইন করে দেই। আমি প্রচন্ড অসহায় বোধ করতে থাকলাম। আমার মাথা কোন কাজ করছিলো না। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
তারা আমাকে পৌণে সাতটার দিকে এয়ারপোর্টে নিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জে বসালো। হাইকমিশনার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে বলে রেখেছিলেন বিমান ছাড়ার ঠিক আগে শেষ মুহুর্তে আমাকে নেয়া হবে।
কিছুক্ষণ পর অফিসার আমার পদত্যাগপত্রটি তৈরী করে সই করার জন্য নিয়ে আসলো। আমি বললাম, অনিরুদ্ধ রায়ের সাথে কথা বলা ছাড়া আমি স্বাক্ষর করবো না। অনিরুদ্ধ রায় ফোনে আমাকে বললো, সে এখন ধানমন্ডি খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অফিসারকে বললাম, এভাবে হবে না। তাকে তার বাসায় যেতে হবে এবং আমি তার স্ত্রীর সাথেও কথা বলে নিশ্চিত হবো।
কিছুক্ষণ পর সে আবার ফোন এনে দিলো। ওপাশে অনিরুদ্ধের স্ত্রী কান্না করতে করতে তার স্বামীর জীবনে বিনিময়ে আমাকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে অনুরোধ জানাচ্ছিলো। ডিজিএফআই চীফ ফোনে আমাকে বললেন, তাদের কথা না শুনলে অনিরুদ্ধ রায়ের পরিণতি হবে খুব খারাপ।
আমার মনে হলো, হিটলারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী গেষ্টাপোর সাথে এদের কোন পার্থক্য নেই। তারা দরকার হলে অনিরুদ্ধ রায় এবং আমার পরিবারের সদস্যদেরকে প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে।
আমার বিমান ছাড়ার সময় ঘনিয়ে আসছিলো। এ সময় অনিরুদ্ধ রায় ফোনে বললো, সে তার বাসার সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। আমি পদত্যাগপত্রটিতে স্বাক্ষর করে হাইকমিশনারের হাতে তুলে দিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে পৌছে দিতে অনুরোধ করলাম।
ভয়াবহ এই ঘটনা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। একটা সভ্য দেশের সরকার কিভাবে তার প্রধান বিচারপতির সাথে এমন আচরণ করে, এটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। তার উপর স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আছেন। যে নেত্রীকে কাছ থেকে এতো ঘনিষ্ঠভাবে দেখে এসেছি, তিনি আমার সাথে এমন নিষ্ঠুরতা করতে পারেন তা আমি যেন নিজ চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারিনা।
আমি জানি শেখ হাসিনা একজন শিক্ষিত এবং মার্জিত রাজনীতিবিদ। কিন্তু ক্ষমতা এখন তাকে নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ করে তুলেছে। ক্ষমতার বুভুক্ষায় তিনি তার অতীত ভুলে গেছেন। অথচ বাস্তবতা হলো, আমাদের অনেকের সাহায্য ছাড়া তিনি এতোদিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন না।
২০১৪ সালে তিনি নিজেও বিশ্বাস করতে পারেননি যে তিনি আবার ক্ষমতায় আসবেন। সে কারণেই সব নিয়ম ভেঙে তিনি আগের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সংসদ ভেঙে না দিয়ে আবার শপথ গ্রহণ করে বসেন। সবাই মনে করেছিলো হয়তো দুই বছরের ভেতরেই আবার নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় পোক্ত হয়ে বসেছেন। এর কারণ হলো বিরোধী দলের দুর্বলতা, প্রতিবেশী ভারতের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিচার বিভাগের ভূমিকা।
ভারতের বুঝা উচিত, বাংলাদেশের জন্য তাদের অনেক ভালো অবদান আছে কিন্তু তারা অনেক খারাপ কাজও করতেছে। তারা এখন বাংলাদেশের সাথে দাদাসুলভ আচরণ করে। দেশের সব নদী থেকে তারা পানি নিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের আধিপত্য কায়েম হয়েছে। এসব সুবিধা পাওয়ার জন্য তারা এমন এক সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে রেখেছে, যে সরকার গণতন্ত্র, আইনের শাসন কিংবা মানবাধিকারের কোন তোয়াক্কা করে না। সীমাহীন দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম-খুন, বৈষম্য এখন সর্বগ্রাসী। গণপ্রজাতন্ত্র এখন অর্থহীন একটি শব্দ।
কিন্তু ক্ষমতার জোর দিয়ে চিরদিন জনগণকে শাসন করা যায় না। নেপাল ও শ্রীলংকা থেকে ভারত যদি শিক্ষা না নেয়, তাহলে খুব শীঘ্রই এমন এক দিন আসবে যখন তাদেরকে দুই দিক থেকে দুই পাকিস্তানের মোকাবেলা করতে হবে। তখন তাদের নিজেদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে যাবে।”
পৃষ্ঠা:–(৪৮০–৫২৩/শেষ পর্যন্ত সংক্ষেপিত অনুবাদঃ–A Broken Dream’s by Surendrow Kumar Sinha.)






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*