সমাবেশ হয়তো সফল,উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ৷ আবদুল গাফফার চৌধুরী৷৷
বাংলাদেশে একটি গল্প প্রচলিত আছে। সত্তরোর্ধ্ব বয়সের এক ব্যক্তি গলব্লাডার অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অস্ত্রোপচার যিনি করবেন, সেই ডাক্তার ছিলেন বয়সে তরুণ। অস্ত্রোপচারে তাঁর দক্ষতার ওপর রোগীর বড় ছেলের কোনো আস্থা ছিল না। অপারেশন টেবিলে রোগীকে নেওয়ার সময় তিনি ডাক্তারকে বললেন, ‘অপারেশন ইজ সাকসেসফুল, বাট পেসেন্ট ডায়েড’—এ কথা যেন আপনার মুখে শুনতে না হয়। তাহলে আপনার খবর আছে।
গত রবিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির একলা উদ্যোগে মহাসমাবেশটি অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্ণ বিবরণ জানার পর ওপরের গল্পটি আমার মনে পড়েছে। সমাবেশটি সফল হয়েছে হয়তো। কিন্তু এই সমাবেশ করার উদ্দেশ্যটি মাঠে মারা গেছে। যদি স্বাভাবিক পরিবেশে সমাবেশটি হতো, তাহলে বলতাম সমাবেশটি সফলও হয়নি। কারণ এ যুগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৫০ হাজার লোকের সমাবেশ (নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী) কোনো ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। গণজাগরণ মঞ্চের দুর্দিনেও তাদের ডাকে ঢাকায় তিন লাখ লোকের সমাবেশ ঘটেছিল।
তবু এই সমাবেশের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বিএনপির যুক্তি মেনে নিচ্ছি। তাদের নেত্রী জেলে (নেতানেত্রী জেলে থাকলেই বরং দলের সমাবেশে বেশি লোক হয়) এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে পলাতক। দলটির দাবি অনুসারে তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। অনেকের মাথায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে। সুতরাং তারা সমাবেশে আসতে পারেনি। তার ওপর পুলিশ কর্তৃপক্ষের ২২ দফা শর্ত মেনে এই সভা করতে হয়েছে। বিএনপি নেতারা যুক্তফ্রন্টের সভায় গেছেন। কিন্তু নিজেদের সমাবেশে তাদের আমন্ত্রণ জানাননি। তাহলে কাদের অমিয় বাণী শোনার জন্য মানুষ এই সমাবেশে আসবে? মির্জা ফখরুল, মোশাররফ হোসেন ও রিজভীর?
বিএনপির এখন সুদিন নয়। তাই তাদের সমাবেশ অনুষ্ঠানের সীমাবদ্ধতার কথা মানি। পুঁথির পঙিক্ত এখন তাদের বেলায় খাটে—‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, শুমার করিয়া দেখি চল্লিশ হাজার।’ তবু পুঁথির এই সংখ্যার চেয়ে ১০ হাজার লোক তো বেশি হয়েছে! সেদিক থেকে সমাবেশটি সফল হয়েছে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির সমাবেশে ৫০ হাজার লোক হওয়ারও কথা ছিল না।
কেউ কেউ বলছেন, গত রবিবারের সমাবেশে সাধারণ মানুষ বেশি যায়নি। বিএনপির সমর্থক দ্বারা মাঠ ভরানো সম্ভব ছিল না। সুতরাং আগেকার সমাবেশগুলোর মতো জামায়াতের সমর্থকদের এনে মাঠ ভরানো হয়েছে। তাতে সমাবেশটি একেবারে ফ্লপ করেনি। কিন্তু উদ্দেশ্যটি ছিল আওয়ামী লীগকে দেখানো, রাজনীতির মাঠ তাদের দখলে। যুক্তফ্রন্টকে দেখানো, তাদের ছাড়া বিএনপি একাই রাজনীতির মাঠে একমেবাদ্বিতীয়ম। যুক্তফ্রন্ট সমাবেশ ডাকলে এর সিকি ভাগ লোকও হবে না। সুতরাং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হলে বিএনপির সঙ্গে শর্তহীনভাবে (জামায়াতকে বিতাড়ন করা) হয়তো বিএনপির নেতৃত্ব মেনে ঐক্য গড়তে হবে।
এই উদ্দেশ্যের কথা স্পষ্ট হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের কণ্ঠে। তিনি সমাবেশে বলেছেন, ‘এখন একটা আওয়াজ উঠেছে, জাতীয় ঐক্য হবে। হবে কি না হবে আল্লাহই জানেন। হলে ভালো, না হলে ক্ষতি নেই। ঐক্য হোক আর না হোক, বিএনপিকে একাই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।’ এটাই বিএনপি নেতাদের মনের আসল কথা। তাঁরা ভেবেছিলেন, দলনেত্রী কারাগারে থাকলে তাঁর ও দলের জনপ্রিয়তা বাড়ে। সুতরাং খালেদা জিয়ার বন্দি অবস্থায় সমাবেশ ডাকলে আগের সমাবেশের চেয়েও বেশি লোক হবে। তাতে আওয়ামী লীগ সরকার ভয় পাবে। যুক্তফ্রন্ট ঐক্য গড়ার ব্যাপারে শর্ত তুলে নেবে। দেশের বাইরের প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকদেরও দেখানো যাবে, বিএনপি একক শক্তিতেই কতটা বলীয়ান।
আমার ধারণা, নেতানেত্রীদের জেলে রেখে বিএনপি মহাসমাবেশ নয়, একটি সমাবেশ যে করতে পেরেছে, এটা তাদের সাফল্য। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে সমাবেশটি করা হয়েছে, অর্থাৎ সরকারকে দাবি আদায়ের জন্য ভয় দেখানো, যুক্তফ্রন্টকে জামায়াত-সংক্রান্ত শর্ত তুলে নিয়ে বিএনপিকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করা, ভারত, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে দেখানো, বাংলাদেশে বিএনপির জনসমর্থন কত বিশাল। এই উদ্দেশ্য পূরণ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির গোঁদা পায়ের লাথি দেখে আওয়ামী লীগ ভয় পায়নি। যুক্তফ্রন্টও বিএনপির একক শক্তি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবে, তা মনে হয় না। যুক্তফ্রন্ট তথাকথিত ঐক্য প্রক্রিয়ার নামে বিএনপির সঙ্গে গেলেও ডুববে, না গেলেও ডুববে। তার প্রমাণ পেতে দেরি হবে না। আর ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি শক্তি? তাদের সিভিল ও মিলিটারি ইনটেলিজেন্স এত দুর্বল নয় যে বিএনপির রবিবারের সমাবেশ তাদের মন হরণ করতে পারবে।
এক বছর পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা অনুষ্ঠান করতে গিয়েও বিএনপি তাতে কোনো অভিনবত্ব দেখাতে পারেনি। বহুকাল আগে আওয়ামী লীগ যা করেছিল, তার অনুকরণ করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফায় আন্দোলনে জেলে বন্দি, তখন আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে এক সমাবেশ ডেকেছিল। বঙ্গবন্ধুকে করা হয়েছিল সমাবেশের সভাপতি। বঙ্গবন্ধু সভায় আসতে পারবেন না, সে জন্য মঞ্চে সভাপতির চেয়ারটি খালি রাখা হয়েছিল। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিয়েছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী।
তখন প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়নি। স্কাইপে, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও ইমোর সাহায্যে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে মঞ্চে স্ক্রিন খাটিয়ে কোনো নেতার সশরীরে বক্তব্য শোনার সুযোগ ছিল না। এখন এই সুযোগ হয়েছে। বিএনপি জেলে বন্দি খালেদা জিয়ার নাম অহেতুক ব্যবহার না করে তাদের ‘প্রিয় নেতা’ তারেক রহমানকে স্কাইপে বা হোয়াটসঅ্যাপের সাহায্যে ঢাকার সমাবেশে তাঁর ‘সংগ্রামী ভাষণ’ প্রচারের ব্যবস্থা করল না কেন? লন্ডনের এক বিএনপি নেতা আমাকে বলেছেন, এটা করার কথা বিএনপি বিবেচনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তা অমান্য করার সাহস বিএনপি দেখাতে পারেনি। এই বীরের দল দেখাবে রাজপথে আন্দোলন করার সাহস? তারা সন্ত্রাসের রাজনীতি জানে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রাজনীতি জানে কি?
সমাবেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মওদুদ আহমদ, মির্জা ফখরুল, রিজভী যে বক্তৃতা দিয়েছেন তাতে দেশের রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতি উপলব্ধি করার কোনো প্রমাণ নেই। আছে অসারের তর্জন-গর্জন। মির্জা ফখরুল একমুখে বলছেন, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান ঘটাবেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে হুমকি দিচ্ছেন, দেশের পুলিশ, সরকারি কর্মচারী যারা বর্তমান সরকারের আদেশ-নির্দেশ মানছে (যেটা সরকারি চাকরির নিয়ম) বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের একহাত দেখে নেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘৯ মণ ঘি কি জুটবে, রাধাও কি নাচবে?’
সমাবেশে ঘোষিত বিএনপির সাত দফা দাবি নিয়ে নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। ঢাকার মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরেই বলা হয়েছে, ‘বিএনপি উত্থাপিত সাত দফা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ৫ দফারই অনুরূপ।’ আমি তা নিয়ে এর আগে একাধিকবার আলোচনা করেছি। বিএনপি পাঁচ দফার সঙ্গে দুটি নতুন দফা যোগ করেছে। তা হলো নির্বাচনের আগে বেগম জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানসহ সব বন্দির মুক্তি। বিএনপির দাবি হলো, নির্বাচনের আগেই হাসিনা সরকারকে পদত্যাগ করে বিএনপির পছন্দের নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে সরিয়ে দিয়ে বিএনপির পছন্দের নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সামরিক বাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন তদারকিতে নামাতে হবে। ইভিএম বর্জন করতে হবে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অবাধ ক্ষমতা দিতে হবে। এককথায় নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার আগেই প্রকারান্তরে বিএনপির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। এগুলোর অধিকাংশই কি রাজনৈতিক দাবি, না মামার বাড়ির আবদার?
বিএনপির সমাবেশে দলের ঘোষিত ১২ দফা লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করাও হাস্যকর। এগুলো মথি লিখিত সুসমাচার। সব দলের গঠনতন্ত্রে অথবা নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে থাকে। সবই ভালো ভালো কথা। কাজির গরু যেমন কেতাবে থাকে, খোঁয়াড়ে থাকে না, তেমনি এসব সৎ কথা রাজনৈতিক নেতাদের মুখে থাকে, বাস্তবে কার্যকর হয় না। হলে দেশে এত অভাব, দারিদ্র্য, অবিচার ও অনাচার থাকত না।
বিএনপি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকাকালে এই ১২ দফার লক্ষ্যের একটিও বাস্তবায়ন করেছে, না প্রতিটি লঙ্ঘন করেছে? দেশে কারা দলনিরপেক্ষ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার নামে নিরপেক্ষ সরকারি কর্মচারীদের পিঠে আওয়ামীপন্থী ছাপ মেরে নির্মমভাবে ছোট-বড় চাকরি থেকে সরিয়েছে এবং দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনের নামে কারা দেশে বাস্তিল দুর্গের মতো ভয়াবহ হাওয়া ভবন তৈরি করেছিল? সন্ত্রাস দমনের নামে কারা বাংলা ভাইদের জন্ম দিয়েছিল? বিএনপি এখন মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা চায়। কাদের সরকার তুচ্ছ অজুহাতে একটি দৈনিকের উপদেষ্টা সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক এবং প্রকাশক ও সাংবাদিকদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে? কোন দলের সরকার বিরোধী দলের নেত্রীর সভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালিয়ে রাজনীতিতে চরম বর্বরতার নজির স্থাপন করেছে?
তালিকা লম্বা করতে চাই না। তা হবে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা। বিএনপির ১২ দফা লক্ষ্যের ঘোষণা শুনে ‘বৃদ্ধ বয়সে বাঘ শিকার ধরতে অক্ষম হয়ে অহিংসা ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে বলে যে খবর জঙ্গলে রটনা করেছিল’ সেই গল্পের কথা মনে পড়ছে। ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নারা এই সেদিনের এক ব্রুটাল ফোর্সের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চান দেশে তাদের কল্পিত গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে! হাসব, না কাঁদব?
সমাবেশে বিএনপি থেকে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ৩ অক্টোবর জেলা শহরে সমাবেশ ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ এবং ৪ অক্টোবর বিভাগীয় শহরে সমাবেশ ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি পেশ। এ যে দেখছি একেবারেই গান্ধী টাইপের অহিংস ও নিরামিষ আন্দোলন। বাঘ মাংস ছেড়ে দিয়ে ঘাস খেতে চাইছে, এটা কি দেশের মানুষ বিশ্বাস করবে?
সমাবেশে মির্জা ফখরুল হুংকার দিয়ে বলেছেন, ভবিষ্যতে (ক্ষমতায় এলে) তাঁরা আওয়ামী লীগের সব কিছুর তদন্ত করবেন। কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না বলে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে চেয়েছেন। সম্ভবত তিনি আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখছেন। তাঁদের অতীতের কুকর্মের তদন্ত হয়েছে বলেই তো তাঁদের নেত্রী আজ কারাগারে এবং ভারপ্রাপ্ত নেতা আদালতের দণ্ডাদেশ এড়াতে বিদেশে পলাতক। মির্জা ফখরুল, নিজের কথাও ভেবে দেখুন। তাঁর সম্পর্কেও তদন্ত হলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর পিতার ভূমিকা ও তাঁর নিজের বর্তমান ভূমিকার জন্য তিনি নিজেও কি একদিন মানুষের ও ইতিহাসের দুই আদালতের বিচার থেকে রেহাই পাবেন? যিশুখ্রিস্ট বলেছেন, ‘ওহে মানব, অপরের চোখে ছোট একটি কাঁটা দেখার আগে নিজের চোখের বড় কাঁটাটি লক্ষ করো।’