প্রাণের ৭১

এই জঙ্গি অপারেশনের কোড নাম ছিল ‘শেখ হাসিনাকে হালকা নাস্তা করানো হবে’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছাড়াও আরও তিনবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা। এর মধ্যে দু’বার হত্যাচেষ্টার সময় সরকার প্রধান ছিলেন শেখ হাসিনা। আরেকবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। শেষবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। বর্বরোচিত এই হামলা মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, এই জঙ্গি অপারেশনের কোড নাম ছিল ‘শেখ হাসিনাকে হালকা নাস্তা করানো হবে’।

প্রথম হত্যাচেষ্টা

২০০০ সালের ২২ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ মাঠে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সভার দু’দিন আগে ২০ জুলাই সভার প্যান্ডেল তৈরির সময় ৭৬ কেজি ওজনের শক্তিশালী বোমার অস্তিত্ব মেলে। পরদিন গোপালগঞ্জ সদর থেকে ৮০ কেজি ওজনের আরও একটি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার হয়। কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার বিষয়টি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করে বলা হয়েছে— জঙ্গি গোষ্ঠীর এটি ছিল প্রথম চেষ্টা। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়,২০০০ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর সুপার মার্কেট এলাকার অফিসে বৈঠক করে শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেয় হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন না হলে আলেম সমাজ ও ইসলামের শত্রুরা বাংলাদেশে শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলেও মত দেয় হুজি নেতা। মুফতি আব্দুল হান্নান, মাওলানা আব্দুর রউফ, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা সাব্বির আহম্মেদ, জাহাঙ্গীর বদর, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, মাওলানা আবু বক্কর, আবু মুসা, লোকমান ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিল। পরে খিলগাঁও থানা এলাকার মুগদায় আরেকটি বৈঠকে কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী সভামঞ্চের কাছেই পুকুর পাড়ে বোমা পুঁতে রাখা হয়। বিষয়টি স্থানীয় চায়ের দোকানের কর্মচারীর নজরে আসে। খবর পেয়ে প্রথমে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পরে সেনাবাহিনী বোমা উদ্ধার করে। সেইসঙ্গে ব্যর্থ হয় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার প্রথম পরিকল্পনা।

দ্বিতীয় হত্যাচেষ্টা

২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই অনুষ্ঠানে বোমা মেরে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা। কিন্তু ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদীতে দু’টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে ধরা পড়ে ১৫ জঙ্গি। এভাবে ব্যর্থ হয় দ্বিতীয় দফায় হত্যাচেষ্টা।

তৃতীয় হত্যাচেষ্টা

২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেটে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে আরেক দফা হত্যার পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে হজরত শাহজালাল (রা.) এর মাজারে যাওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনার। সেখানে ওঁত পেতে ছিল জঙ্গিরা। কিন্তু শেখ হাসিনা সেখানে যাননি। জঙ্গিরা খবর পায় য, কর্মসূচি পরিবর্তন করে শেখ হাসিনা যাচ্ছেন হজরত শাহ্ পরান (রা.) এর মাজারে। সেখানেও ওঁত পেতে থাকে তারা। যদিও শেখ হাসিনা  শাহ্ পরানের মাজারেও যাননি। এরপর জঙ্গিদের কাছে খবর আসে যে, শেখ হাসিনা সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে জনসভা করবেন। জঙ্গিরা তখন জনসভা স্থলের কাছেই একটি বাসায় জড়ো হয়। তবে ওই আস্তানায় বসে অসতর্কতাবশত নাড়াচাড়া করতে গেলে বোমা বিস্ফোরণে দুই জঙ্গি নিহত হয়। সেই সঙ্গে ভেস্তে যায় সিলেটে হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অভিযোগপত্রে এ বিষয়ে বলা হয়— সুযোগ মতো বোমা আক্রমণ করতে না পেরে সিলেট শহরে ডা. আরিফ আহম্মদ রিফার বাসায় যায় জঙ্গিরা (ওই বাসায় ভাড়া থাকতো জঙ্গিরা)। সেখানে বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় বিস্ফোরণ হলে হরকাতুল জিহাদ নেতা আবু মুসা ও লোকমান নিহত হয়। তারা মুফতি হান্নানের সহযোগী। তাদের আরেক সহযোগী মাওলানা আবু সাঈদ অন্য কক্ষে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায়। প্রসঙ্গত, মাওলানা সাঈদ মুফতি হান্নানের ‘গুরু’ হিসেবে পরিচিত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেফতার হয়ে সে বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছে।

২১ আগস্ট হত্যাচেষ্টা

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে চতুর্থ ও শেষবারের মতো  গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীরা। ওই হামলায় শেখ হাসিনা গুরুতর আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন ২৪ জন নেতাকর্মী। বর্বরোচিত এই হামলা মামলার অভিযোগপত্রে ২০ ও ২১ আগস্ট জঙ্গি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের তৎপরতা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে— ‘২০ আগস্ট মুফতি হান্নানের সহযোগী আহসানউল্লাহ কাজল ও মুফতি মঈন ওরফে আবু জানদাল তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসায় যায়। সেখানে পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন তাদের হাতে তুলে দেয় ১৫টি গ্রেনেড। ওই গ্রেনেডগুলো নিয়ে তারা যায় মেরুল বাড্ডায় আহসানউল্লাহ কাজলের বাসায়। সেখানে মুফতি হান্নানের সঙ্গে বৈঠক করে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলার কৌশল চূড়ান্ত করে। ২১ আগস্ট মুফতি হান্নান ও  মাওলানা সাঈদের নির্দেশে মহিবুল্লাহ অভি ওরফে মফিজুর রহমান, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের,শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, আবু জানদাল, আরিফ হাসান সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক, রফিকুল ইসলাম সবুজ, উজ্জল ওরফে রতন, মহিবুল্লাহ মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন, খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, ইকবাল, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন জুবায়ের, ওমর ফারুক, শুভ, ফেরদৌস বাবু ওরফে মো. রাতুল বাবু, আহসান উল্লাহ কাজল ও মো. মাসুদ সরাসরি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে যায়। তারা বিকাল পাঁচটা ২২ মিনিটের দিকে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায়। এই অপারেশনের কোড নেম করা হয় ‘শেখ হাসিনাকে হালকা নাস্তা করানো হবে’।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*