প্রাণের ৭১

সাজাপ্রাপ্ত দুজন একাত্তরে ছিলেন হানাদার বাহিনীতে

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ১৪ বছর আগে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে আছেন বেশ কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযোগ ও রায় অনুযায়ী, তাঁদের কেউ কেউ গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন; কেউ ঘটনার পর আলামত নষ্ট করতে ভূমিকা রেখেছেন; কেউ আবার হামলাকারীদের কাউকে কাউকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন কিংবা পালাতে সহায়তা করেছেন। যাঁর যাঁর অপরাধের ধরন অনুযায়ী সাজা পেয়েছেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী) হত্যা করার উদ্দেশ্যেই যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মদদে তা সবার জানা হয়ে গিয়েছিল আগেই। আদালতের ঘোষিত রায়েও সে বিষয়টি উঠে এসেছে। রায়ে এমনটিও বলা হয়েছে যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিকতাই হলো ২১ আগস্টের ট্র্যাজিক ঘটনা।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কারাগারের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসকে উল্টে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই দেশে, এমনকি রাষ্ট্রে পুনর্বাসিত হয়েছিল অনেক স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতিকই শুধু নয়, একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিলে বাঙালি হত্যায় মেতে ওঠা অনেক ঘাতকও।

একাত্তরের মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীসহ ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যদের হানাদার প্রতিরোধচেষ্টা থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত। পাশাপাশি পাকিস্তান বাহিনীতে কর্মরত কতিপয় বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে উল্টো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বিভিন্ন দলিল থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকায় যাঁরা ছিলেন তাদের সংখ্যা ৮০ জনের বেশি। তাঁরা সবাই ছিলেন কর্মকর্তা। সিপাহিদের মধ্যে তেমন কেউ হানাদার বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেননি। বাঙালি হয়েও যেসব সেনা কর্মকর্তা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই পরবর্তীকালেও দেশ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত হন।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় পুলিশের সাবেক দুই আইজি মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হককে দুই বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়ায় দণ্ডবিধির ২১২ ধারায় দুই বছর করে এবং কোনো অপরাধীকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করায় দণ্ডবিধির ২১৭ ধারায় আবার দুই বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে উভয় শাস্তি একই সঙ্গে চলবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে। এ মামলায় দীর্ঘদিন তাঁরা জামিনে ছিলেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক শুনানি সমাপ্তির দিন তাঁদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়। সেই থেকে তাঁরা কারাবন্দি।

মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক এ এস এম সামছুল আরেফিনের ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মো. শহুদুল হক ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে ২৯ ট্যাংক রেজিমেন্টে ছিলেন রংপুর সেনানিবাসে। মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর নাসির উদ্দিনের ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থসহ বিভিন্ন দলিল থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে রংপুরের রাজনৈতিক নেতারা সর্বদলীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের ছায়াতলে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার উপায় বের করার পরিকল্পনা করছিলেন। একপর্যায়ে রংপুর সেনানিবাসে কর্মরত এক বাঙালি সেনা সদস্যের কাছ থেকে একটি গোপন বার্তা পেয়ে রাজনৈতিক নেতারা ২৮ মার্চ সেনানিবাস ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৮ মার্চ বিকেলে সেনানিবাসের আশপাশের এলাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালি, সাঁওতাল এবং ওঁরাও সম্প্রদায়ের ৩০ থেকে ৩৫ হাজার লোকের সমাবেশ ঘটান এবং তীর-ধনুক, দা-বল্লম ইত্যাদি নিয়ে সেনানিবাস ঘেরাও অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব সূত্রে খবর পেয়ে ওই অভিযান বানচাল করার ছক কষে। সে অনুযায়ী ঘেরাও অভিযানে অংশগ্রহণকারী জনতার ঢল সেনানিবাসের কাছাকাছি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু হয়েছিল। অবিরাম গুলিবর্ষণে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ৫০০ থেকে ৬০০ স্বাধীনতাকামী মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মেজর (অব.) নাসির (তখনকার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট) সেখান থেকে বেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও মো. শহুদুল হকসহ আরো কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা হানাদার বাহিনীর সঙ্গেই থেকে গিয়েছিলেন।

‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ গ্রন্থে উল্লিখিত তথ্য মতে, মো. আশরাফুল হুদা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তিনি ছুটিতে ঢাকায় ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। অথচ অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তাই তখন হানাদারদের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করেছেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেও কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু মো. আশরাফুল হুদা তার কিছুই করেননি। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে পুনর্বাসিত হন। প্রায় একই সময়ে একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ পান মো. শহুদুল হকও। পরে দুজনই পুলিশের শীর্ষ পদেও আসীন হয়েছিলেন।

একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির চেতনার বিপরীতে অবস্থান নেওয়া বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা তাঁদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, কখনো অনুশোচনাও প্রকাশ করেননি। তাঁদের অনেকেই বরং পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে নব্য পাকিস্তান বানানোর ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে পরিচালিত ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হকের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেয় একাত্তরে তাঁদের আরেক সহযোগীর কথা। ১৯৭১ সালে যশোর সেনানিবাসে আর্টিলারি রেজিমেন্টের মেজর মির্জা রকিবুল হুদা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা হানাদারদের সঙ্গেই ছিলেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসিত হন পুলিশ বাহিনীতে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে যাওয়া দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ২৪ জন নিহত হয়েছিল। ওই সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার ছিলেন মির্জা রকিবুল হুদা। তাঁর নির্দেশেই ওই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এসংক্রান্ত মামলার প্রধান আসামিও করা হয়েছিল তাঁকেই। বিচারাধীন ওই মামলায় কারাগারেও ছিলেন রকিবুল হুদা। একপর্যায়ে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তিনি মারা যান। তাঁদের মতো আরো কয়েকজন ‘বাঙালি খানসেনা’ এখনো নানাভাবে তৎপর আছেন।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নাসিরসহ সাতজন জুনিয়র অফিসার এবং আনুমানিক ৫০০ সাধারণ সৈনিক পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। পরে জুন মাসে নাসিরসহ তিনজন অফিসার পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও অবশিষ্ট বেশির ভাগ বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে পাকিস্তানি সেনারা পর্যায়ক্রমে গুলি করে হত্যা করেছিল।

মো. শহুদুল হক যে রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ছিলেন সেটিই ছিল তখন এ দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একমাত্র ট্যাংক রেজিমেন্ট (২৯ ক্যাভালরি)। সেখানে মোট ট্যাংক ছিল ৫৫টি। ট্যাংকের অংশ হিসেবে সঙ্গে ছিল ৫৫টি হেভি মেশিনগান, ১১০টি লাইট মেশিনগান বা এলএমজি এবং এর সঙ্গে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৫৫টি কামান। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এ কে এম শামসুদ্দিনের মতে, একটি আধুনিক কনভেনশনাল যুদ্ধে ট্যাংক যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘১৯৭১ সালে শতকরা হিসেবে রংপুর সেনানিবাসের মতো অন্যান্য সেনানিবাসে মোট জনবলের তুলনায় বাঙালি সেনা সদস্যের আধিক্য না থাকা সত্ত্বেও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অথচ রংপুর সেনানিবাসের স্বার্থপর কিছু বাঙালি অফিসারের নির্লজ্জ বেহায়াপনা, নিজ জীবন রক্ষা এবং সিদ্ধান্তহীনতার জন্য ৫০ শতাংশ বাঙালি সেনা সদস্যের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বিশাল এ ট্যাংকশক্তি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই হাতছাড়া হয়ে যায়।’ (সূত্র : যুগান্তর, ২৮ এপ্রিল ২০১৮)






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*