প্রাণের ৭১

জিয়ার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে নিলেন ড. কামাল হোসেন।।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু নতুন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মায্যদা দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। বাংলাদেশের রণ সঙ্গিতের মায্যদা দিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী” কবিতাটিকে।ভাষা আন্দোলনের অমর সঙ্গীত ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী’ রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী” বছরের প্রথমার্ধ্যে ফেব্রুয়ারী মাসে, কোন বাঙ্গালী অবশিষ্ট থাকেনা মনের অজান্তেই গেয়ে উঠেনা, শোকে মূহ্যমান বাঙ্গালী। ফেব্রুয়ারি মাস এলে এমনকোন বই পড়ুয়া বাঙ্গালী নেই, যে বাঙ্গালীর মনে পড়ে না ”বঙ্গবিবেক আবুল ফজলের অমর রচনা– ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’।

কবিগুরুর দেশপ্রেমের অমলিন শিখা, নজরুলের চির বিদ্রোহের আগুন, গাফফার চৌধুরীর বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে ত্যাগের শোকগাঁথা, আবুল ফজলের বাঙ্গালী জাতির শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরনা যতদিন বাঙ্গালী মানসে অনুরনিত হবে, অনুপ্রানিত করবে, ততদিন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়ীকতার বিষবাস্প ছড়ানোর কোন সুযোগ, কোন মহলের হবেনা। এই সত্যটি সেদিনের প্লে-কাড বহনকারী চরমোনাই পীর সাহেবদের অস্তিত্ব আবহমান টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই বুঝা একান্ত প্রয়োজন ছিল। সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ব্যাবসায়ী, ইহুদির অনুসারি ইসলাম ধর্মে বিচরন করা বকধার্মিক, সাম্প্রদায়িক উগ্র ইহুদী বাদী শক্তির পতনের প্রতি পীর সাহেবের খেয়াল রাখা উচিৎ ছিল। যে চালটি পাতিলে বেশি লাফায়,সে চালটি পাতিলের বাহিরে আগুনের চুল্লি অথবা ঝাড়ুর আগায় তাঁর স্থান হয়।
বাঙ্গালী চেতনায় যতবার আঘাত এসেছে বাঙ্গালী ততবার বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে চক্রান্ত প্রতিহত করেছে। তবু কালের পরিক্রমায় মীরজাফর থেকে মোস্তাক, মোস্তাক থেকে জিয়ার জম্ম হয়েছে এই বাংলায়, বাংলার গর্বিত মায়ের উদরে। তাঁরা কলংকীত করেছে বারবার, বিভিন্নভাবে বাঙ্গালীর জাতীয়তাবোধ, বাঙ্গালীর শ্বাস্বত: সংস্কৃতি আবহমানকালের কৃষ্টিকে। বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালী জাতি কে পরিচয় করে দিতে চেয়েছে-ভাষাহীন, সাম্প্রদায়িক, খুনী, আইন, বিচার, রাষ্ট্র কাঠামো না মানা অসভ্য জাতি হিসেবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান একুশের চেতনাকে অত্যন্ত কৌশলে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা ভিত্তিক গড়ে উঠা সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে তাঁর মেধা, কৌশল, প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক দুরদর্শীতা দিয়ে তিলে তিলে দেশভিত্তিক আন্দোলনে রূপদান করেছিলেন। সেই দেশটির নামও রেখেছিলেন তিনি নীজের মুখে, স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র কয়বছর আগেই। মীর জাফর জিয়া অনুধাবন, অনুকরন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ধারাবাহিকতা শয়তানের অন্তদৃষ্টি দিয়ে।কোথায় থেকে কোথায় এসে পরিনতি পেয়েছিল জাতির জনকের সংগ্রামের ইতিহাস।মেজর জিয়া তদানুযায়ী বঙ্গবন্ধুর শুরু থেকে ধংশের কৌশল অবলম্বন করেছিল অত্যান্ত সুচুতুরতার সঙ্গে, সুক্ষভাবে। তিনি ভাষা আন্দোলনের মুলচেতনা বাঙ্গালী জাতিয়তা বোধকে কনডেম করে জিন্নাহর ধর্ম ভিত্তিক” দ্বি-জাতি ” তত্ত্বের চেতনা প্রয়োগ করতে থাকেন, তার রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনৈতিক কৌশলে।
তিন হাজার বছর পুর্বে গড়ে উঠা বাঙালীর ইতিহাস ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে ধারন করে “বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের” উৎপত্তিস্থলে ১৯৭১ ইং সালের ১৬ ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে প্রতারীত করে, তাঁর অনুকরনে “বাংলাদেশী জাতীয়তা বাদ” প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন৷ এই এক শঠতার ধুম্রসৃষ্টি করে মোহ মায়ার ইন্দ্রজাল বিছানো চতুরতায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির করুন এক নিদর্শন। মানুষ মানুষকে প্রতারিত করে করতে পারে কিন্তু দেশ এবং জাতির সাথেও তদ্রুপ করতে পারে, সাধারন আমজনতা কি বুঝার কোন সামর্থ রাখে?
প্রিয় পাঠক আপনাদের অনেকেরই মনে আছে, মেজর জিয়ার প্রথম “রাজাকার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান “১৯৭৯ সালে সংসদে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে -বাংলা ভাষার নামকরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়ার পরামর্শেই তিনি এই ঘোষনা দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার রঙ গাঁয়েমাখা মীরজাফর জিয়ার পরামর্শ ছাড়া প্রেসিডেন্ট শাসিত” সরকারের প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষনা দিতে পারেনা।সংবিধান স্থগিতাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীর চাকুরি তখন” রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল।সুতারাং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ব্যাতিরেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা দিয়েছিলেন–তাও কি বিশ্বাস করতে হবে?
দেশ ভাগ হতে পারে, খন্ড বিখন্ড হতে পারে একই ভাষাভাষির মানুষ কিন্তু ভাষা কি ভাগ হতে পারে? বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের “আরবজাতি ” বহুধা ভাগে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন নামে দেশ শাষন করছে কিন্তু তাঁদের জাতীয়তাবোধের চেতনা “আরব জাতীয়তাবাদ” কি পরিবর্তন হয়েছে? ,নাকি কখনও কেউ পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছে? তাঁদের আরবি ভাষার কি পরিবর্তন হয়েছে? তাঁদের সংস্কৃতির বন্ধন যদি আরবি ভাষা হতে পারে, আমাদের সংস্কৃতির বন্ধন বাংলায় অসুবিধা কোথায়? বিয়ে, জম্মদিন, আরব জাতির নিজস্ব জাতীয় উৎসবে আনন্দে, পালাপার্বনে উলুধ্বনী দেয়ার প্রথা তাঁদের আবহমান কালের। তাঁদের সেই কৃষ্টির কি পরিবর্তন হয়েছে? নবী করিম (স:) করেছেন নাকি পরবর্তি কোন ধর্মীয় নেতা করেছেন? তবে বাঙ্গালী সংস্কৃতি অনুসরনে বা বাংলা ভাষা,সংস্কৃতি, কৃষ্টিতে ইসলাম ধর্মের অমায্যদা হবে?
মুলত: শাহ আজিজকে দিয়ে হিন্দু-বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি উস্কে দিয়ে সাধারন বাঙ্গালী মসুলমানদের সস্তা সেন্টিমেন্টকে পুজি করে পাকিস্তানী ধারাকে পুন: প্রতিষ্ঠিত করার মানষে জিয়া উল্লেখিত ঘোষনাটি সংসদে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। জিয়াই আনুষ্ঠানিক ভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ধ্বংসের ভিত্তি স্থাপন করেন। এখানে শেষ হলেতো ভালই ছিল, তারপরের ইতিহাস আরো বর্বর, করুন, হৃদয়বিদারক। “বাংলাদেশ বেতারের” নাম পরিবর্তন করে তিনি রাখেন “রেডিও বাংলাদেশ”.।চালনা বন্দরের নাম পরিবর্তন করে রাখেন, “পোর্ট অব চালনা”। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনী “জয় বাংলা” শ্লোগানকেও পরিবর্তন করার স্পর্ধাও দেখান মুক্তিযুদ্ধা জিয়া। জয় বাংলার জায়গায় পাকিস্তানী ভাবধারার শ্লোগান ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্থাপন করেন তিনি।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই যে–‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” শ্লোগান বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর দাঁড়িয়ে খুনিরা ১৫ আগষ্ট প্রত্যুষ্যেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় ভীত সম্ভ্রস্তভাবে রেডিওতে বারবার বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘোষনা দেয়ার পরেই উচ্চারন করেছিল। জিয়া বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা খুনীদের উচ্চারীত শ্লোগানটিই নিজ কন্ঠে ধারন করেন। আর কয়বছর সময় পেলে হয়তোবা “পাকছার জমিন নেছা দোবাত’কেও” আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির অঙ্গ “জাতীয় সঙ্গীত” বলে চালিয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহন করতেন তিনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে—বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের জন্য যে সমস্ত পত্র দেয়া হত সেখানে” নিমন্ত্রন” শব্দটি পয্যন্ত উঠিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎসময়ের সভাপতি বর্ষিয়ান জননেতা জনাব মরহুম আবদুল মালেক উকিল প্রতিবাদ জানালে তাঁকে “ভগবান দাশ” বলে বিদ্রুপ করতেও তাঁদের বিবেকে বাঁধেনি।
মুলত: ছোটছোট পরিবর্তন করে বাঙ্গালী মননে ধারন করিয়ে—বড় পরিবর্তনের সুদুরপ্রসারী চিন্তা করেছিলেন জিয়া। তাঁর সেই চেতনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন বিগত ১৯৯৬ ইং সাল পয্যন্ত সরকার গুলী। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে—যদি বাংলা—ইংরেজী শব্দ প্রয়োগ বা বিন্যাসে অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়,সেই ক্ষেত্রে বাংলা শব্দটির প্রাধান্য পেয়ে প্রতিস্থাপিত হবে। মেজর জিয়া এই জায়গাটুকুতেও পরিবর্তন করে বসিয়ে দেন ইংরেজী প্রধান্যের বিষয়টি। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ,কৃষ্টিতে ছোট ছোট পরিবর্তন করে বড় পরিবর্তনের মানষিকতা গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন জিয়া এবং তাঁর পরর্তী সামরিক, সেনাসমর্থীত বেসামরিক ফ্যাসিবাদি সরকার সমুহ।
জিয়ার মিত্রশক্তি এবং স্বাধীনতাবিরুধী অবস্থান, ইতিহাস ঐতিহ্য পরিবর্তন, সংস্কৃতি, কৃষ্টির উপর নগ্ন হামলা, মাতৃ ভাষা বাংলায় পরিবর্তনের সূচনা মূলত: পাকিস্তানী ধারায় পিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টার ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধু খুনের মাষ্টার মাইন্ড জিয়ার মুক্তিযুদ্ধ বিরুধী চেতনার ধারাবাহিকতা হচ্ছে আজকের দিনের ভাস্কায্য বিতর্ক সহ এযাবৎ উত্থাপিত খালেদা, তারেক, মঈনুল, ড. কামাল, জাফর উল্ল্যা সহ অনেকের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা তথা দেশদ্রোহী বক্তব্য।
ড. কামাল হোসেন এতদিন বাহিরে বাহিরে থাকলেও সম্প্রতি দেশ বিরুধী অশুভ শক্তির মহাজোটের নেতৃত্ব গ্রহন করে আনুষ্ঠানীকভাবে তাঁর মুখোষ জনসমখ্যে প্রকাশ করলেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে এতকালের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বিরুধী, জাতির জনক বিরুধী অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করলেন তিনি নিজেই৷
–স্বাধীনতা বিরুধী শক্তির অবস্থান বিরোধীতাকারী জিয়ার প্রকৃত অনুসারী এবং কামাল সাহেবের দীর্ঘদিনের বন্ধু, রাজনৈতিক মিত্রশক্তি ড. বদরদৌজা চৌধুরী মাথায় পা দিয়ে কামাল সাহেবের দেশ বিরোধী শক্তির নেতৃত্ব গ্রহন কোনমতেই খাটো করে দেখার উপায় নেই৷ তাছাড়া বিএনপির ন্যায় একটি জনসমর্থিত দল বাংলাদেশের কোন একটি অঞ্চল যার নির্বাচন করার স্থান নেই এমন এক নেতার কাঁধে জোটের নেতৃত্ব তুলে দেয়ার পেছনে কোন ষড়যন্ত্র নেই –এমনটি ভাবা মনে হয় কোন মহলেরই উচিৎ হবেনা৷






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*