মাসুদা ভাট্টি যে এত শক্তিধর জানতাম না: তসলিমা নাসরিন
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন নারী’ বলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে নিয়ে বিতর্ক চলছেই। মানহানির মামলা থেকে শুরু করে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইছে দেশ-বিদেশে।
এ ঘটনায় মাসুদা ভাট্টির সমালোচনায় সরব আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তিনিও গত রোববার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে মাসুদা ভাট্টিকে ‘ভীষণ রকম চরিত্রহীন’ বলেন। তার এ মন্তব্যের পাল্টা জবাবও দিয়েছেন মাসুদা ভাট্টি।
সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ২৩ মিনিটে তসলিমা নাসরিন তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
মাসুদা ভাট্টি যে এত শক্তিধর জানতাম না। কেউ তাকে একটা গালি দিল, বাহ সে ২০ কোটি টাকার মামলা ঠুকে দিল। আর সেই লোক, শুনেছি বিরাট কিছু, গ্রেফতার হয়ে গেল, তাকে এখন জেলের ভাত খেতে হচ্ছে। আমার মাথার মূল্য যে লোক ঘোষণা করেছে, যে লোক আমাকে খুন করার জন্য জনসভার হাজারো লোককে আদেশ দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে যদি আমি মামলা করতে যাই, পারব?
আমার কিছু বই বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে, বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে এবং বাকস্বাধীনতার পক্ষে যদি সামান্য মামলাও করতে যাই, পারব? পারব না। কারণ আমাকে দেশে ঢুকতে দেয়া হয় না। আমি কোনও উকিলকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে পারি আমার হয়ে মামলা করার জন্য। তাই না? কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কিছুতেই চায় না আমি কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিই। কোনো উকিলকে নয়, নিজের বোনকেই অনেকগুলো বছর ধরে চেষ্টা করছি দিতে, বাংলাদেশের কোনও দূতাবাসই আমাদের পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ডকুমেন্ট সত্যায়িত করে না। আমাকে পঙ্গু বানিয়ে রাখা সরকারি সিদ্ধান্ত। আমি দেশে ফিরতে পারব না, আমার বই লোকে পড়তে পারবে না, আমি কারো বিরুদ্ধে, এমনকি কোনও খুনির বিরুদ্ধেও মামলা করতে পারব না।
লোকে কার পক্ষে থাকে? ক্ষমতার পক্ষে নাকি অনাথের পক্ষে? অবশ্যই ক্ষমতার পক্ষে। তাই আছেও সে রকম। ক্ষমতা অন্যায় করলেও ক্ষমতাকে ‘ভিকটিম’ সাজানো হয়েছে। অনাথের সব দোষ। অনাথ কেন সত্যটা বলে দিল, কেন অসময়ে হাটে হাঁড়ি ভাঙল? সরকারি লোকেরা এক পক্ষ। বিশাল সেই পক্ষ। অন্যদিকে আমি একা। সরকারবিরোধী লোকেরা আমার পুরনো শত্রু। তারাও তো এককালের সরকার। কোনো তফাত নেই ওদের আর তাদের ভেতর। সবাই তসলিমাবিরোধী।
মাসুদা ভাট্টি নামক ক্ষমতাবান আমার সত্য ফাঁসের ‘জবাব’ দিয়েছে। জবাব তো নয়, আবারও এক রাশ মিথ্যের কলস উপুড় করেছে। আমি তাকে আমার পাবলিশার হিসেবে নাকি ফ্যান হিসেবে পরিচয় করিয়েছি, বড় ব্যাপার নয়। সে আমার পাবলিশারও নয়, ফ্যানও নয়। আমাকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে নিয়েছে নিজের স্বার্থের জন্য।
সবচেয়ে বড় যে মিথ্যেটি ছিল, সেটি হলো ‘সে বাংলাদেশে ফিরে গেলে তাকে মৌলবাদীরা মেরে ফেলবে’ -এই মিথ্যে বাক্যটির কারণে সে ব্রিটেনে পলিটিক্যাল এসাইলাম পেয়েছিল। তখন তার পক্ষে নাকি সাংবাদিকরা দাঁড়িয়েছিল, তবে কারো দাঁড়ানোর জন্য কিন্তু তার পলিটিক্যাল এসাইলাম হয়নি, হয়েছে আমার চিঠির কারণে। ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা কথা বলল, এই সত্যটা কিন্তু বলল না। ব্রিটেনে পলিটিক্যাল এসাইলাম এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার পর আমাকে কিন্তু কোনো ধন্যবাদও দেয়নি। দেবে কেন, আমার পিঠে ছুরি বসাবার জন্য তখন তো ছুরি শানাতে ব্যস্ত ছিল। উপকারীর উপকার স্বীকার করতে তার ইচ্ছে তো হয়ই না, বরং অপকার করতে ইচ্ছে হয়।
এই উপকারের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করতাম না, যদি বদমাইশি না করত। ক্ষতিকর লোকদের চিহ্নিত করতে হয় সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য। অপ্রেসর এখন চমৎকার ভিকটিম রোল প্লে করছে। বলছে, আর কত শাস্তি আমি দেব তাকে? কী শাস্তি আমি তাকে দিয়েছি, শুনি। তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি? ব্রিটিশ সরকারকে দিয়ে তার এসাইলাম তুলে নিয়েছি? না কিছুই করিনি। তবে কি বাঙালি পাঠককে সত্য তথ্য জানানোর নাম শাস্তি?
আরও বড় মিথ্যা কথা লিখেছে, সে নাকি আমার বইয়ের সমালোচনা করেছে, ব্যক্তি আক্রমণ করেনি। রিয়েলি? দেখাক তার তিন কিস্তিতে লেখা তসলিমার প্রতি ঘৃণা আর নিন্দা ছুড়ে দেয়া সেই নোংরা গালাগালিগুলো? তার লেখার শিরোনাম ছিল ‘ তসলিমা নাসরিনের ক– ফুরিয়ে যাওয়া যৌবনের আত্মযৌবনিক কামশাস্ত্র’। শিরোনাম পড়েই নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়, কী বলতে চেয়েছে সে। ওই নোংরা জিনিস আমি রাখিনি, কিন্তু নিজের রচনা তো নিজে সে রেখেছে। দেখাক। মানুষ পড়ুক।
তসলিমা কুড়ি বছরে কুড়িবার লিখেছে তার কীর্তিকলাপ সম্পর্কে? ২০০৩ থেকে এখন ১৫ বছর। তো এই ১৫ বছরে তাহলে ছন্দ মিলিয়ে তাকে বলতে হবে ১৫ বার। সত্য শতবার উচ্চারণ করতে হয়, ১৫ বার তো কমই। এই ১৫ বছরে তার একবারও কেন ইচ্ছে করল না ক্ষমা চাইতে? আজ যখন বড় বড় বুদ্ধিজীবী আর নারীবাদী দাঁড়িয়ে গেছে মাসুদাকে কেন চরিত্রহীন বলা হলো এই প্রতিবাদে, তখন কেন আমার মনে হবে না এরা সব হিপোক্রিটের জাত? তখনই বলতে ইচ্ছে করেছে চরিত্রহীনকে চরিত্রহীন বলবে না তো কী বলবে! আমি কোনো ‘মোক্ষম’ সময় বেছে নিইনি। সব সময়ই সত্য বলার সময়। যারা নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত, তাদের কাছেই সত্য বলার জন্য এই সময়টা ভালো, ওই সময়টা খারাপ। আমার কাছে নয়।
মইনুল হোসেন কী কারণে মাসুদাকে চরিত্রহীন বলেছেন, সে মইনুল হোসেন জানেন। আমি তাকে কী কারণে চরিত্রহীন বলেছি, ব্যাখ্যা করেছি। মাসুদা দাবি করেছে আমার পক্ষে সে লিখেছে অনেক। মানুষের সহানুভূতি কাড়ার জন্য ন্যাকামো বেশ জানা আছে তার। আমার সহানুভূতি পাওয়ার জন্যও একসময় ন্যাকামো করেছিল, আড়ালে ছুরিতে শান দিচ্ছিল। এখন সরকারি আরাম আয়েস জুটছে তার, রথী মহারথীরা তাকে ঘিরে আছে, আর সে ভান করছে, তার নাকি সংকটকাল চলছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দোষ দিয়েছে আমাকে, আমি দেশের রাজনৈতিক অবস্থার এদিক-ওদিক করে দিয়েছি।
আমি একা মানুষ, কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক, ধর্মীয় দল আমার পক্ষে কোনো দিন ছিল না, থাকবেও না। মাসুদা ভাট্টির মতো আমি প্রভাবশালী নই। আমার কোনো ক্ষমতা নেই রাজনীতির জগতে কোনো ঢিল ছোড়ার। আমার মতো রাজনীতি না বোঝা বোকা লোক যেমন সংসারে আছে, মাসুদা ভাট্টির মতো ধূর্ত লোকেরা চিরকালই ছিল, আছে। মানুষের পিঠে চড়ে চড়ে উঁচুতে গিয়ে ওঠে, তারপর লাথি মেরে ফেলে দেয় নিচের মানুষদের।
আমি অনেক লোক দেখেছি জীবনে, মাসুদা ভাট্টির মতো এত ভয়ঙ্কর মিথ্যুক আর চরিত্রহীন জীবনে দেখিনি। আমাকে নিয়ে মন্দ কথা অনেক লোকই লিখেছে, এসবে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু যার জীবনের সবচেয়ে বড় উপকারটি আমি করে দিলাম, উপকারটা লুফে নিয়ে সে যখন আমার বই রিভিউয়ের নামে ব্যক্তি আমাকে জঘন্য আক্রমণ করে, যৌন হেনস্তাকারীর পক্ষ নিয়ে আমাকেই করে কুৎসিত পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণ, তখন কষ্ট হয়। সেই কষ্ট থেকেই লিখেছি গতকাল (রোববার)।