প্রাণের ৭১

আমার বাবা ফরাস উদ্দিন ও নির্বাচন।।আসাফ ফরাস উদ্দিন।।

পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক প্রথা এরকম- কোনও নতুন ব্যক্তি যখন কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেন তখন তাকে তার পরিবারের সদস্যরা পরিচয় করিয়ে দেন। অনেক নতুন রাজনীতিবিদ তাদের পেশাগত পরিচয়ের মাধ্যমে ‘পাবলিক ফিগার’ হয়ে যান, কিন্তু জনগণ তাদের ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে তেমন জানতে পারে না।

আমি পরিবারের সদস্য হিসেবে গর্বিত সন্তান হিসেবে আমার বাবা ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের ব্যক্তিগত সামান্য কিছু বিষয় তুলে ধরছি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাবা এবার হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী।

এই লেখাটি দেশের আপামর মানুষ তো বটেই, তার নির্বাচনী আসনের (মাধবপুর-চুনারুঘাট) ভোটারদের আরও কাছ থেকে বাবাকে চিনতে সহায়তা করবে।

অনেকেই আমার বাবাকে তার সততা, নিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা বা দেশপ্রেমের জন্য চেনেন। আমি আমার শিশুকালের দু’চারটি মধুর স্মৃতিময় ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। এর কয়েকটি ক্ষেত্রবিশেষে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে অনেকের কাছেই ।

আমার বয়স তখন চার বছরের কাছাকাছি। সন্ধ্যার একটু পর অনেকেই হয়তোবা রাতের খাবারও খেয়েছে; ঢাকার জনগণ উল্লাসে ফেটে পড়ছে; চারদিকে আতশবাজী হচ্ছে অনেকে পটকা ফোটাচ্ছে। আমি বাবার কাছে দৌড়ে গিয়ে উদ্বিগ্নতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা কী হয়েছে?’ আমি তখন বাবার মুখে বিশাল হাসি দেখতে পেলাম। এতে আমি স্বস্তি পেলাম এবং ভালো লাগলো। বাবা বললেন, ‘আজকে একটা বিশাল দিন, আজ বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত সূচিত হলো।’ দিনটা ছিল ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি যেদিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।

আমাদের জাতির জন্য সূচনাকালটা সুখের ছিল না। সদ্য স্বাধীন কোনও দেশের সূচনাকাল সুখের হওয়ারও কথা নয়। অনুরূপভাবে আমাদের দুই ভাইবোনের শিশুকালটাও সুখের ছিল না। অভাব ছিল, অনিশ্চয়তা ছিল। আমার বাবা ইউএসএইড এর বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করতে গেলেন। বৃত্তি চারজনের সংসারের জন্য অপ্রতুল। মা- কে বাধ্য হয়ে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে চাকরী নিতে হয়। বাবা রেকর্ড পরিমাণ স্বল্প সময়ের নিয়ে সেখান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় অথবা জাতিসংঘের অন্তর্ভূক্ত কোনও দেশে অনেক উচ্চতর পদে কাজে যোগ দিতে পারতেন। যদি তিনি বোস্টনে থেকে যেতেন বা জাতিসংঘের অন্তর্ভূক্ত কোন দেশে চাকরি নিতেন তাতে আর্থিকভাবে অনেক স্বচ্ছলতা পেতেন। আমারা দু ভাইবোন হয়তোবা অভিজাত জীবন যাপনের সুযোগ পেতাম। বিভিন্ন সময়ে বাবার মুখের বিভিন্ন কথা; দেশের মানুষ সম্পর্কে তার ভাবনা চিন্তা চেতনা আমাদের মনে কখনোই অভিজাত জীবন যাপনের অভিলাষ তৈরি করেনি।

জাতিসংঘের উচ্চতর বেতন ও শত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত চাকরির প্রতি আগ্রহ না দেখিয়ে সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে দেশের জনগণের সেবা করার মানসে ১৯৭৯ সালে বাবা দেশে ফিরে আসেন। সময়টা অনুকূলে ছিল না। মেজর জিয়াউর রহমানের স্বৈরশাসনের অন্ধকার যুগ চলছিল। তা সত্ত্বেও বাবা দেশে ফেরার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন এবং ফিরেছিলেন।

আমার বাবাকে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের অধীনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইকোনোমিক রিলেশন ডিপার্টমেন্ট (ইআরডি) বিভাগে কাজ করার সুবাদে খুব ঘন ঘন বিদেশে সফর করতে হতো। তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ সহায়তার জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে সভা করতেন এবং তাদেরকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে অর্থ সহায়তা করার জন্য রাজি করাতে পারতেন। এটা তার স্রষ্টা প্রদত্ত অতিরিক্ত যোগ্যতা বলেই মনে হয়।

তার সতাতা ও নিষ্ঠা দেশের প্রতি অমোঘ ভালোবাসা আমার শিক্ষা জীবনেও প্রভাব ফেলে। আমি ধানমণ্ডির স্কলাস্টিকা টিউটোরিয়ালে ভর্তি হই। এতে আমার বাবা গর্বিতও ছিলেন। আমি আমার বাবাকে প্রায় তার সহকর্মীদের বলতে শুনেছি, “আমি আমার সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া না করিয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়াবো।”

আমি নবম শ্রেণিতে স্কলাস্টিকা টিউটোরিয়াল থেকে সিদ্দিকীস টিউটোরিয়ালে ভর্তি হলাম। এ স্কুলটা আমাদের মোহাম্মদপুরের সরকারী বাসভবন থেকে কাছে ছিল এবং এখানে লেখাপড়ার খরচও কম ছিল। ভর্তির পর স্কলাস্টিকার শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ মিসেস মোরশেদ আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং সেখানে ফিরে যেতে বললেন। আমি বাবার কাছে গিয়ে তার উপদেশ চাইতেই বাবা সততার গুরুত্ব সম্পর্কে বললেন। বাক্যটা ছিল এরকম, “বাবা তুমি কিন্তু জনাব সিদ্দিকীকে ওয়াদা দিয়েছো।”

একজন সৎ সরকারী কর্মকর্তার এত টাকা পয়সা থাকে না যে, তিনি তান সন্তানকে বিদেশে লেখাপড়ার জন্য পাঠাতে পারেন। আমার বাবার ক্ষেত্রে তা শতভাগ সত্য ছিল। অনিচ্ছা স্বত্বেও আমার বাবাকে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে জাতিসংঘের একটি চাকরির জন্য আবেদন করতে হয়েছিল। তিনি থাইল্যান্ডে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে একটি আকর্ষণীয় চাকরির প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সংস্থাপন সচিবের অনুমতি না পাওয়ায় সেখানে যোগ দিতে পারেননি।

পরে অবশ্য অনুমতি পেলেও আমার বাবাকে একটি দরিদ্র দেশে আবাসিক প্রতিনিধির চেয়ে নিম্নতর উপ-আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে চাকরিতে যোগ দিতে হয়েছিল। এতেও তাকে আমি কখনো আক্ষেপ করতে দেখিনি। তিনি সর্বদাই দেশের প্রতি এবং সরকারী চাকরির দায়িত্ব কর্তব্যের প্রতি অনুগত ছিলেন। এ অবস্থা থেকে কখনও এক বিন্দুও নড়চড় হতে দেখিনি। ইউএনডিপিতে ১৩ বছরের সফল চাকরির পর আমার বাবা আশ্চর্যজনকভাবে (কারো কারো কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে) জাতিসংঘের শত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিলেন এবং পরিবার পরিজন নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিদেশে থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসলেন।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। তিনি বাংলাদেশের গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন; যারা কঠিন পরিশ্রম করে লেখাপড়া শিখে একটি চাকরির মাধ্যমে পরিবার, সমাজ এবং দেশের উন্নয়নের জন্য অবদান রাখবে। এ মানসে ১৯৯৬ সালে তিনিসহ তার সমমানসিকতা সম্পন্ন ১৫ (পনেরো) জন মিলে ঢাকায় একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। এটাই দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম- ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী স্বল্পতম খরচে শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে দেশ ও জাতির উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

আমার বাবার কাছে জাতিসংঘের উচ্চ বেতন ও শত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত চাকরির চেয়ে সততা এবং দেশের প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব অধিক। তার দেশপ্রেমের স্বীকৃতিও তিনি ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তিনি (শেখ হাসিনা) আমার বাবাকে দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার সময়ে তিনি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে ব্যাংকিং খাত যাতে আন্তরিক থাকে এবং সাধারণ জনগণের জন্য ব্যাংকিং খাত যাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে তার জন্য সদা সচেষ্ট ছিলেন।

আজ আমার বাবা ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর- চুনারুঘাট) সংসদীয় আসনের সর্বস্তরের জনগণের পক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়েছেন। এটা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে সেবা দেয়ার জন্য একটি উপযুুক্ত প্লাটফরম এবং তার সারা জীবনের লালিত বাসনা দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন করার একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*