প্রাণের ৭১

ড. কামাল হোসেনে’র বুদ্ধিজীবি ফ্রন্ট।।আবদুল গাফফা্র চৌধুরী।।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীঃঃ–ব্যক্তিগত জীবনের নানা সমস্যার মধ্যে আছি। আশিঊর্ধ্ব জীবনে শরীর এবং স্বাস্থ্যও ভাল নয়। লন্ডনে হঠাৎ বেজায় শীত পড়েছে। তাতেও কাবু হয়ে আছি। তারপরও ঢাকার একটি কাগজে একটি খবর দেখে খুব মজা পেয়েছি। শেরে বাংলা একবার বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক সার্কাসের চাইতে বড় সার্কাস আর কিছু হয় না।’ কথাটা যে কতটা সত্য ঢাকার কাগজের একটি খবরের হেডিং দেখে তার প্রমাণ পেলাম। ১৩ নবেম্বরের ডেট লাইন দেয়া খবরটির হেডলাইন হলো, ‘১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নির্বাচনে সম্পৃক্ত করতে চান ড. কামাল, বিএনপিকে চিঠি।’ এই খবরটা পড়েই খুব মজা পেয়েছি।

খবরে বলা হয়েছে, ‘বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য (যিনি সেনাপ্রিয় নামে পরিচিত), ড. হোসেন জিল্লুর, আকবর আলী খান এবং সুলতানা কামালসহ ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে চান ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ড. কামাল ১০ জনের এই তালিকা বিএনপিকে পাঠিয়েছেন এবং অনুমোদনের জন্য তারেক রহমানের কাছেও তালিকাটির কপি পাঠানো হয়েছে।

এই তালিকায় থাকা অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হলেন, হাসান মশউদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ড. জাফরুল্লা চৌধুরী, শাহদীন মালিক, আলী ইমাম মজুমদার ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তালিকায় এই গোত্রের আরও দুটি নাম না দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। এই দুুটি নাম হলো প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তালিকায় এই দুটি নাম যুক্ত থাকলে ষোলোকলা পূর্ণ হতো।

বহু বছর আগে পাকিস্তানী জমানায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের নুরুল আমিন সরকার তাদের দল ও সরকারের প্রতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন আছে (তরুণ বুদ্ধিজীবীদের সকলেই তখন হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের পক্ষে) তা দেখানোর জন্য তাদের নামের একটা তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই তালিকাটি দেখে পঞ্চাশের দশকের বিখ্যাত সম্পাদক প্রয়াত কাজী মোহাম্মদ ইদরিস তার কলকাতায় থাকার সময়ে লেখা ‘সব মুখ চেনা’ নামের একটি গল্পের চরিত্রের নামগুলো একটু পাল্টে ঢাকার একটি সাপ্তাহিকে প্রকাশ করেছিলেন আরেকটি গল্প। তাতে কয়েকটি নাম লিখে পাশে মন্তব্য করেছিলেন, এরা সকলেই বুদ্ধিজীবী বটে, তবে মুসলিম লীগের খয়ের খাঁ। মুসলিম লীগ সরকারের অনুগ্রহভোগী।

তিনি কয়েকটি নামের পাশে মন্তব্য লিখেছিলেন- কবি গোলাম মোস্তফা, সরকারী কবি। প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ, সরকারী দলের সমর্থক এবং খাজা নাজিমউদ্দীনের ব্যক্তিগত বন্ধু, মন্ত্রী হতে চান। আবুল কালাম শামসুদ্দীন, সরকার সমর্থক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক এবং মুসলিম লীগ দলীয় এমএনএ বা প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য, পরে সদস্যপদ ত্যাগ করেন। খায়রুল কবির, নুরুল আমিনের মালিকানাধীন দৈনিকের সম্পাদক। বদরুদ্দীন, উর্দুভাষী ঢাকার খাজা পরিবারের অর্থে পরিচালিত ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজের সম্পাদক। ভাষা আন্দোলনের সময় এই পত্রিকার অফিস বিক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে ফেলে।

এভাবে কাজি মোহাম্মদ ইদরিস মুসলিম লীগের ইনটেলেকচুয়্যাল ফ্রন্টের যে কজন বুদ্ধিজীবীর নাম দিয়েছিলেন তারা তখন ছিলেন সকলের কাছে চেনামুখ মুসলিম লীগপন্থী। এবারও ড. কামাল হোসেন যে ১০ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরি করে বিএনপি ও তারেক রহমানের কাছে তাদের নির্বাচন সহযোগী বুদ্ধিজীবী ফ্রন্ট গঠনের জন্য অনুমোদন চেয়ে পাঠিয়েছেন, সেই বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশকে নিয়ে আমি কাজি মোহাম্মদ ইদরিসের মতো একটি স্যাটায়ার লিখতে পারি ‘সব মুখ চেনা।’ জানি না, এই ১০ ব্যক্তির সকলের সম্মতি নিয়ে ড. কামাল হোসেন তার তালিকা প্রস্তুত করেছেন কিনা। যদি করেও থাকেন, তাহলে বলব, তিনি নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢেলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন। এদের অধিকাংশই কে কবে আওয়ামী লীগপন্থী অথবা নিরপেক্ষ ছিলেন? এদের রেকর্ড কি বলে? এদের বিএনপির পক্ষে এনে কি দল ভারি করা যাবে?

খবরে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, তারা নির্বাচনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বুদ্ধিজীবীদের এ রকম একটি তালিকা তৈরি করা নিয়ে বিএনপির হাই কমান্ড শলাপরামর্শ করেছেন। বিশিষ্ট এসব ব্যক্তি যদি নির্বাচনে জড়িত হন অথবা সরাসরি নির্বাচন করতে চান (ধানের শীষ নিয়ে কি?) তাহলে বিএনপি তাদের স্বাগত জানাবে।’ আমার ধারণা, তারেক রহমানও এদের স্বাগত জানাবেন। কারণ, এই তালিকার অধিকাংশ ব্যক্তি বিভিন্ন সামরিক ও স্বৈরাচারী আমলে বহু ব্যবহৃত হয়ে জনগণের কাছে ধরা পড়া ব্যক্তিত্ব। তারেক রহমান জানেন, এরা নামে নিরপেক্ষ বিশিষ্টজন হলেও সামরিক ও স্বৈরাচারী আমলের ‘গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী’ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি। নির্বাচনে এদের সহযোগী করে এনে দল ভারি করা হলে ক্ষতি নেই। লাভ কিছু না হোক। বাইরে তো দেখানো যাবে, বিএনপির প্রতি দেশের বেশ ক’জন বুদ্ধিজীবীরও সমর্থন রয়েছে।

খবরটি পাঠ করে আমার ‘লেজ কাটা নীল বর্ণের শৃগালের’ গল্প মনে পড়ছে। ধোপার বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে এক শৃগাল ধোপার কাপড় ধোয়ার জন্য টবে রাখা নীল মেশানো পানিতে পড়ে যায় এবং তার লেজও কাটা যায়। তখন সে আর সব শৃগালকে ডেকে বলেছিল, ভাইসব, আসুন আমরা সবাই লেজ কেটে ফেলি এবং শৃগাল সমাজে অভিজাত শ্রেণী হয়ে যাই। শৃগালেরা রাজি হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করুন আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে যোগদানের জন্য প্রথমে একটি তথাকথিত ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে তাকে সিঁড়ি করে বিএনপি জোটের নেতা হয়েছেন। এখন তার ইচ্ছা, তার সমমনা বুদ্ধিজীবী এবং বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তিও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করুক। আমার ধারণা, তাতে এই দশ ব্যক্তির সকলেই রাজি হবেন না। তারা আওয়ামী লীগবিরোধী হতে পারেন। কিন্তু সকলেই বিএনপির টবে নীল জলে স্নান করে নীল বর্ণের শৃগাল হতে চাইবেন কিনা সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে।

কাজি মোহাম্মদ ইদরিস লিখেছিলেন, ‘সব মুখ চেনা’। ড. কামালের তালিকার দশ ব্যক্তির সব মুখ আমারও চেনা। যেমন ড. জাফরুল্লা ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। এদের হাসিনা বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। এরা দু’জনে ইতোমধ্যেই ঐক্যফ্রন্টের কাতারে বিএনপি-জামায়াত জোটে আছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য। ইনি এক এগারোর আধাসামরিক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলের অনুগ্রহভোগী ব্যক্তি এবং সেনাপ্রিয় ভট্টাচার্য্য নামে পরিচিত। ড. হোসেন জিল্লুর। ইয়াজউদ্দীন আহমদের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের শেষদিকের উচ্ছিষ্টভোগী উপদেষ্টা। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তার বিএনপিপন্থী না হওয়ার কারণ নেই। তার বাবা ছিলেন জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী। শাহ দীন মালিক। আওয়ামী লীগ বিরোধী আইনজীবী। কিছুদিন আগে ঐক্যফ্রন্টের সভায় যোগ দিয়েছেন এবং ফ্রণ্টের আইনী পরামর্শদাতা। আলী ইমাম মজুমদার সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে তার কলাম পড়ে মনে হয় নিরপেক্ষতার আড়ালে তিনিও বিএনপি ঘরানার লোক।

এই ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তির তালিকায় যুক্ত দু’ব্যক্তি আকবর আলী খান ও সুলতানা কামাল সম্পর্কে আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি, এরা যথার্থই নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী এবং কোনভাবেই বিএনপি ঘরানার লোক নন। ইয়াজউদ্দীনের প্রথম তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বিএনপির প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ আচরণ ও অন্যান্য অবৈধ কার্যকলাপের জন্য তারা উপদেষ্টা পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। এরা দু’জনেই মাঝে মাঝেই আওয়ামী লীগ সরকারের কোন কোন কাজের সমালোচনা করেন বটে, কিন্তু কট্টর আওয়ামী লীগবিরোধী নন।

ড. কামাল হোসেন হয়ত এ দু’জন নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীর নাম তার তালিকায় ঢুকিয়ে তালিকাভুক্ত আর সকলের পরিচয় ঢাকা দিতে চেয়েছেন। অর্থাৎ শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে কি? প্রাক্তন সিভিল ব্যুরোক্র্যাট এবং একজন বুদ্ধিজীবী আকবর আলি খানকে আমি যতটা জানি, তিনি সকল দল কর্তৃক আমন্ত্রিত হলে নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় সে কাজে সহযোগিতা দিতে আসবেন, কিন্তু কামাল হোসেনের ট্র্যাপে পা দেবেন না।

সুলতানা কামালও একজন দৃঢ়চেতা মনের বুদ্ধিজীবী। টিআইটির সঙ্গে এবং আরও দু’একটি আইনী অধিকার সংক্রান্ত গ্রæপের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার দরুন ড. কামালের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এবং সম্ভবত তার ওপর ড. কামালের কিছু প্রভাবও আছে। তাতেও আমি মনে করি না ড. কামাল কোনভাবেই সুলতানা কামালকে বিএনপির গোয়ালে নিয়ে ঢোকাতে পারবেন।

ড. কামালের আগামী নির্বাচনে সাফল্য সম্পর্কে নিজের ওপর আস্থা নেই। নদীতে নিমজ্জিত ব্যক্তি যেমন তৃণখন্ড আশ্রয় করে বাঁচতে চায়, তিনি এখন তেমনি হাতের কাছে খড়কুটো পেলেও তা আশ্রয় করে বাঁচতে চাচ্ছেন। এখন প্রশ্ন, দশ ফেরেশতার যে তালিকা তিনি তৈরি করেছেন, সেই ফেরেশতারা দু’একজন বাদে কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে কিনা? তার গণফোরামকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবে গঠনের সময় দেশের বেশ কয়েকজন সিনিয়র বুদ্ধিজীবীকে তার প্ল্যাটফরমে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। কেউ তার সঙ্গে থাকেনি। এমনকি তার তিন ‘জানি দোস্ত’- রেহমান সোবহান, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. নূরুল ইসলামকেও কাছে টানতে পারেননি। এবার দেখা যাক, বিএনপির কাঁধে চড়ে তিনি নির্বাচনী পুল সেরাত পার হতে পারেন কিনা?






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*