ধর্মের নামে বেসাতি গাওয়া তেঁতুল হুজুরদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের আইন-আদালত কতদিনে সচল হবে?
গত জুম্মার নামাজের খুতবায় দেওয়া ভাষণে তেঁতুল হুজুরদের শিরোমনি শফী হুজুর ওরফে তেঁতুল হুজুর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে জাতিকে আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, পঁচে যাওয়া নির্যাস থেকে ভাল কিছু কল্পনা করা যায় না। নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া চরম নারী বিদ্বেষী কিছু কীট আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় এবং তাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মারণাস্ত্র হলো ধর্মের কিছু মনগড়া গল্প। অথচ, ধর্মে বিশ্বাসী অনেকেই কোথাও খুজে পাবেনা যে পবিত্র গ্রন্থের কোথাও সরাসরি বলা আছে যে, নারীরা শিক্ষিত হতে পারবেনা। যদিও বলা আছে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীন দেশে গমন করবে।
১৪০০ বছরের বেশি পূর্বের বাস্তবতায় হয়তো কাঙ্ক্ষিত সুযোগ কিংবা অজ্ঞতার জন্য ততকালীন সময়ে নারী শিক্ষার খুব একটা সুযোগ না থাকলেও বেশকিছু নারী তাদের শিক্ষাদীক্ষায় ইসলাম ধর্মেও অবদান রাখতে পেরেছে যা দ্বীনি শিক্ষায় কোরান ও হাদিসের ব্যাখ্যায় বেশকিছু নারীর পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে বিভিন্ন ধর্মে নারীদেরকে অবহেলিত এবং দূর্বল জ্ঞান করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেও দেখা যায়। এর বড় কারণ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীকে দুর্বল করে দেখার মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা এবং ধর্মগুলোর সবগুলোতেই অবতার রূপে আবির্ভূত মানুষটি ছিলেন একজন পুরুষ। এক্ষেত্রে তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে সেসব আদি ইতিহাস পরিবর্তনকামী মানুষটিও নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি পাছে নিজের শৌর্যবীর্যে ছেদ পড়ে। তাই, যুগযুগ ধরে নারীকে অবমূল্যায়ন ও অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে তাকে বাঁধার সম্মুখীন করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়।
মেয়েরা শিক্ষিত হলে তেঁতুল হুজুরদের কদর কমে যাবে বলেই হয়তোবা তার মতো মোল্লাদের গা জ্বালা করে। স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত বলে একসময় গ্রামীণ জনপদে ওয়াজ নসিহত দেওয়া হতো কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন প্রমাণিত যে, কোরান বা হাদিসের কোথাও এটা লেখা নেই বরং স্ত্রীকে আদব লেহাজের সাথে ভালবাসার কথা বলা হয়েছে এবং কোন প্রকার কটুবাক্য ছুড়ে দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। অথচ, খুঁজলে এখনো হাজার হাজার কনটেন্ট পাওয়া যাবে যেখানে তেঁতুল হুজুরদের বক্তব্যে উঠে এসেছে যে, স্বামী যেখানে যেখানে মারবে সেখানে দোযখের আগুন পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারবেনা এবং মা বোনেরা তোমরা স্বামী মারলে প্রতিবাদ করোনা তাতে আল্লাহ বেজার হবেন এবং তুমি জাহান্নামী হবে কিন্তু নারী শিক্ষার ফলে মেয়েরাও হাদিস কোরান পড়েন আর জেনেছেন এগুলোর কোনটাই সঠিক নয়। তাই, আমপারা বা কায়দা পড়া তেঁতুল হুজুরদের কদর সমাজে আগের মত নেই এবং হুজুরদের মনগড়া গল্পও ইদানিং গ্রামবাংলায় কল্কে পায়না, সেজন্য নারীশিক্ষার প্রতি তেঁতুল হুজুরদের বিদ্বেষ বা বিরোধিতা সর্বাধিক। কারণ- মেয়েরা শিক্ষিত হলে এদের সস্তায় বিক্রি করা পাঁচমিশালী ওয়াজের ক্রেতার বড়ই অভাব ঘটবে। ধান্দাবাজ সবসময়ই চাই তার জারিজুরি জেনো ফাঁস হয়ে না যায়।
আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে যখন সমাজ সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে দিনকে দিন যেখানে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে সেখানে এরকম পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনায় আবদ্ধ মানুষগুলো সমাজের অভিশাপ হিসেবে নিজেদের জানান দিতে ধর্মের নামে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বক্তব্য নিয়ে দেশবাসীর সামনে হাজির হয়ে কুৎসিত ও কদাকার যুক্তি তুলে ধরছে। সরকার যেখানে নারীশিক্ষার উন্নয়নে স্নাতক পর্যন্ত মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিতে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে সেখানে ১৪০০ বছরের আগের ধ্যান ধারাণায় কিছু মানুষ চিৎকার করে পরিবেশ দুষিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অথচ, স্বাধীন দেশে একটা সরকার আছে এবং তার নিজস্ব কিছু আইনকানুন আছে যা দিয়ে দেশের ভালমন্দ বিচার বিশ্লেষণ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। সর্বোপরি যে দেশের রাষ্ট্র প্রধান থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ স্তরে মেয়েদের পদচারনায় রীতিমতো বিপ্লব সাধিত হয়েছে সে’দেশে ধর্মের নামে এধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য প্রদান রীতিমতো অপরাধ এবং এই অপরাধে তাকে বিচারের ব্যবস্থা করাও সমীচীন।
একবিংশ শতকে এসে যখন রাষ্ট্রের প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নকল্পে অনগ্রসরমান একটি অংশ কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের মানোন্নয়নে তাদের শিক্ষার সনদপত্রকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে আইনের সুযোগ বৃদ্ধি করলো তখন কিছুটা অবাক হলেও সাধুবাদ জানিয়েছিলাম যে, এবার হয়তো এই বিরাট সংখ্যক মানুষকে আলোর পথে নিয়ে আসতে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নিবে। যদিও প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়েছে তাই একেবারে আশাহত হওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা শফী যখন তার পূর্বের বক্তব্য- মেয়েরা তেঁতুলের মতো বলে চুপ না থেকে বরং তেঁতুল তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় মেয়েদেরকে স্কুলে দিতে নিষেধ করে কিংবা স্কুলে দিলেও ফোর বা ফাইভের বেশি না পড়ানোর অঙ্গীকার করিয়ে উপস্থিত ১৫০০ জনের মতো কুশিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষকে হাত উঁচিয়ে শপথবাক্য পাঠ করাই আর সেই পনেরো শতজনের মতো মানুষ বিনাবাক্যে ধর্ম পালন হয়েছে বলে শপথ নিয়ে বাড়ি ফিরে তখন আশাহত হতে হয়। এজন্য যে, সারাদেশে এদের কতসংখ্যক অনুসারী আছে যারা ধর্ম পালন হয়েছে ভেবে কুকুর শিয়ালের গু-মুত পান করেও শোকরিয়া আদায় করে সোহবত হবে?
সরকারী সুযোগ-সুবিধা আর রেলের জমি দিয়ে এদের পেট কখনওই ভরবেনা বরং ওয়াজ নসিহত করে বিনা পূঁজিতে ও কায়িকশ্রমের বদলে ধর্ম ব্যবসায়ে শুধু এদের গায়ে গতরে বাড়বে এবং রাষ্ট্রের পরিবেশ দুষিত করে উন্নয়ন ও সফলতার রাস্তায় আবর্জনায় পরিণত হবে। তাই, সরকারের উচিত হবে- এসকল দানবদের কার্যকলাপে স্পষ্টভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করে ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা দেওয়া থেকে বিরত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জারি রাখা যাতে ওয়াজ কিংবা খুতবায় রাষ্ট্রের আইন মেনে এবং কোরান বা সহি হাদিসের বাহিরে যা খুশি তা প্রচার করতে না পারে।
সরকারকে ব্যর্থ করতে এরকম পশ্চাৎপদতার চিন্তাচেতনাকে যারা সামনে আনবে তাদেরকে জঙ্গি দমনের মতো শক্ত হাতে দমন করতে হবে আর তা না হলে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অধরাই থেকে যাবে এবং বিশ্বের দরবারে অথর্ব পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্রের সাথে বিবেচিত হবে যা এইসকল পশ্চাদপদ ধ্যানধারণায় বিশ্বাসীরা কামনা করে। কারণ, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এই সব ধর্ম ব্যবসায় নিয়োজিত লোকজন তাদের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের কথা ভুলতে পারেনি বরং সুযোগ পেলেই পাকিস্তানি পতাকা তুলে ধরতে চাইবে আর সেজন্যই তাদের মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত নিষিদ্ধ এবং কোন কোন জায়গায় জাতীয় পতাকাও উত্তোলন হয়না।
সরকার যেহেতু বিশাল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং নিজেরাও তা দাবি করে উন্নয়নের মহাসড়কে চলে যাবার প্রয়াসে ব্যস্ত সেহেতু এই সরকার ও দল হিসাবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বও সবচেয়ে বেশি।
আশাকরি, রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ করে জনগণের উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিবে।
স্কুল কলেজের মতো প্রতিটি মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত পাঠ এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এতে যদি কোন মাদ্রাসা এবং তার শিক্ষকেরা জাতীয় সংগীত পাঠ এবং পতাকা উত্তোলন করতে ব্যর্থ হয়, তবে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে সাজা নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে সেই মাদ্রাসার অনুমোদন বাতিলসহ সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অন্যকোথাও চাকুরিতে যোগদান করার সুযোগ রহিত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবেন এবং তার শিক্ষা মন্ত্রীসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেককে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে এব্যাপারে যথাযথ নির্দেশ দিবেন। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে রাষ্ট্রের আইন বিরোধী কোন বক্তব্য বা হুমকি প্রদানের মতো ঘটনার অবতারণা হলেও অদৃশ্য কারণে তেঁতুল হুজুরদের বিপক্ষে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বরং তাদের অনুভূতি রক্ষায় কে কি লিখে প্রতিবাদ জানালেন তা নজরদারিতে রাখার হুংকার শোনা গেছে। অথচ, রাষ্ট্রীয় আইনকানুনসহ রাষ্ট্রীয় আচার পালনে বাধ্য করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পালনে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দিষ্ট নির্দেশিকা আছে এবং আপামর জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের পরিপালন করা হয় যাতে রাষ্ট্রের ভালমন্দ দেখভাল করে।
জাতীয় ও সমাজ বিরোধীরা যেমন কখনোই রাষ্ট্রের অনুকম্পা পায়না তেমনি ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মনমানসিকতার লোকদের রুখতে না পারলে সেই রাষ্ট্রকে কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে শফী হুজুর ওরফে তেঁতুল হুজুরদের কদর করে নয় বরং আইনের আওতায় নিয়ে আইন পালনে বাধ্য করতে হবে যাতে নারীর অবমূল্যায়নে অবমাননাকর বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করার সুযোগ না পায়। একজন শিক্ষিত মা পারেন তার সন্তানদের সঠিকভাবে লালনপালন করাসহ রাষ্ট্রের বিনির্মাণেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে।
তাইতো নেপোলিয়ন বলেছিলেন-
আমাকে একজন একটা শিক্ষিত মা দাও
আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো।
মোয়াজ্জেম হোসেন তারা
লেখক,এক্টিভিস্ট
ফ্রান্স