বাঙালির বিবেকবুদ্ধি কতদিনে জাগ্রত হবে?
ঝড় আসলে গ্রামের মানুষ কতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে সময় পার করে তা শহরে বাস করা বেশিরভাগ মানুষই বুঝবেনা। ছোটবেলায় ঝড়ের বেগে বেশ কয়েকবার আমাদের টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। গ্রামের আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই আমার মা-ও একজন ধার্মিক মানুষ। ঝড় আসলে আজান দেবার কথা বলতেন হাফপ্যান্ট পরেই সেসময় দু’ভাই আজান দিতে লেগে যেতাম কিন্তু দাদার বানানো পুরনো ঘর হওয়ায় তা যথেষ্ট নড়বড়ে ছিল বলে আজানের সাথে শয়তান আগেভাগেই আপোষ রফা করে রাখায় ইটের দেয়াল ঠিক থাকলেও ছাউনি উঠিয়ে নিয়ে যেতে কার্পণ্য করেনি। ঝড় শেষে মা’কে বলতাম তোমার আল্লাহ আজান শোনেনি বলেই শয়তান চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। মা ধমকের গলায় বলতেন এসব বলতে হয় না বরং আল্লাহ ঈমান পরীক্ষা নেন।
আমার কেন জানি সেসময় জিদ চাপতো যে, যত পরীক্ষা সব গরীব লোকের জন্যেই নিতে হবে? তারপর পরে ঝড় আসলে মা আজান দেবার কথা বললেই আমি বলতাম তোমার আল্লাহ আজান শুনবেনা আর শয়তানও বাঁধবেনা কিন্তু আমার বছর দুয়েকের বড়ভাই ঠিকই ওজু করে আজান দেওয়া শুরু করে দিতো আর মা দোয়াদরুদ পড়ে ধানচাল থেকে শুরু করে লেপ-খেতা পলিথিন দিয়ে ঢাকার নানারকম কসরত করতে থাকতেন এবং ঝড়ের বেগ বেশি হলেই আমাদেরকে খাটের নিচে পাঠিয়ে দিয়ে দরজা চেপে দাঁড়িয়ে আল্লাহ আল্লাহ করে আয়তাল কুরসি থেকে শুরু করে সবরকম দোয়াদরুদ পড়তে থাকতেন। একবার আমার নানা বেড়াতে এসে ঝড়ের কবলে পড়লেন এবং যথারীতি সেবারও টিনের ছাউনি উড়ে গেলে বাঁশের আড়া বুড়োর মাথায় পড়ে কিঞ্চিৎ মাথা কেটে গেলে সে পণ করলো আর কোনদিন বর্ষাকালে আমাদের বাড়িতে আসবেনা। এরপরেও বেশ কয়েকবার এসেছেন কিন্তু কপাল গুনে টিনের ছাউনি উড়ে যায়নি।
যাহোক, ঝড় থামলেই আমাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যেতো ঝড়ে পড়া আম কুড়িয়ে ঝিনুকের খোলায় বিশেষ ছিদ্র করে নানা কসরতে কাঁচা আমের ছাল ছাড়িয়ে বিটলবণ দিয়ে পোড়া মরিচের গুঁড়ো বাটায় আম খাওয়ার মহোৎসব শুরু হয়ে যেতো। তারপর পুরনো ঘরের সামনে আলাদা করে নতুন ঘর তুললেও কেন জানি সেটা ঢালাই ছাদ না করে আব্বা বেশি দামের টিন শেডের ছাউনির ব্যবস্থা করলেন এবং খড়ের ছাউনির রান্নাঘরের পরিবর্তে এরামিটের টিনে সেমি পাকা রান্নাঘর বানালেন। যদিও শেষমেশ দেখা গেলো আমার এক চাচার ঢালাই ছাদের ঘরের চেয়ে আমাদের ঘর তৈরীতে খরচ বেশি পড়েছে। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে অন্যরকম ভাললাগার আবেশ থাকে এবং চারদিকে একটায় আওয়াজ শোনা যায় শুধু অনুভব করতে হয়।
বাবার বানানো ঘর বেশকিছু দিন হলো নড়বড়ে পুরাতন হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে বর্ষায় আবার ফুটো টিন বদলিয়ে কিংবা পলিথিন পেচিয়ে গোঁজামিল দিয়ে চলে যাচ্ছে। বাড়িতে এখন বয়স্ক বাবা-মা কোন রকম সেখানে বসবাস করছে কিন্তু ঝুঁকি থাকায় তাদের জন্য বিশেষ চিন্তা হয়। প্রায়শই ঘর করার কথা বলতে শুনি কিন্তু চাইলেই তো আর ঘরের কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হয় না। টাকাপয়সার সাথে সাথে অনেককিছুর মেলবন্ধন ঘটিয়েই না কাজে হাত দেওয়া লাগে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের বেশ কয়েকবার বলেছি শহরে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে কিন্তু তাদের একই কথা নিজের বাড়িঘর, পুকুর-বাগান, জায়গাজমি থুয়ে যাওয়া যায়?
তাদের কথায় মনে হয় কেউই কখনো জায়গাজমি, ভিটেমাটি রেখে দেশান্তরি হয়নি বা শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়নি?
প্রলয়ঙ্কারী ঝড় ফণী নিয়ে বাঙালির রসবোধে আতঙ্কিত হতে হয়। এদের কাছে সবকিছুই আনন্দের বাতাবরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে আসে সেটা জাতীয় দিবস হোক বা শোক দিবসের অনুষ্ঠান পালিত হোক না কেন বরং এরা অপেক্ষায় থাকে কখন কার ঘর পোড়ে বা ধ্বস নামে। কিন্তু আমার মতো অনেকেই আছে যাদের কাছে দুর্যোগ মানেই বেঁচে থাকার অবলম্বন বা মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানোর ভয়। হয়তোবা, আপনজনকে হারিয়ে ফেলার অজানা আশংকা। আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট দুর্যোগে উপকূল সংলগ্ন মানুষজন কতটুকু আতংকে থাকে তা বোঝার সামর্থ্য তথাকথিত শিক্ষিত শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত লোকগুলো কখনোই বুঝবেনা। তাইতো কেউ সেলফি তুলে পোস্ট করে ঝড় ফণী দেখতে সপরিবারে কক্সবাজার রওয়ানা দিচ্ছি, আবার কেউ রোমান্টিকতা অনুভব করে চমকপ্রদ খাবারের ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুখরোচক শব্দে উপস্থাপন করতে পারে।
জাতীয় দুর্যোগের মতো ইস্যু নিয়েও একদল আবাল আছে ধর্মের ফেরি করতে ছুটে আসে। বিধর্মী মরলেই বোধহয় মরুভূমির বালুতে সবুজ আগাছা জন্মায় বা সেটা বেহেশতের বাগানে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। ধর্মমতে স্পষ্ট বিধান আছে সকল কিছু আমি সৃষ্টি করেছি এবং এর একমাত্র প্রতিপালকও আমি। সুতরাং, অহেতুক কাউকে কষ্ট দিয়োনা এবং অমঙ্গলও কামনা করতে নিষেধ করেছেন। অথচ, মূর্খের ঔদ্ধত্য দেখলে মনে হয় এদের মতো আবালের জন্যই ধর্ম বেঁচেবর্তে আছে।
সবকিছু দেখেশুনে মনে হয়- বাঙালির জীবনবোধে কেন যে ফণী’র মতো কোন প্রলয়ঙ্কারী ঝড় এসে সবকিছু উল্টেপাল্টে দিয়ে মরুভূমির বালুতে ডুবিয়ে দেয়না তা বুঝে আসেনা। জানি না, ঈশ্বর-ভগবান-আল্লাহ সকলেই হয়তো বহুরূপী চরিত্র দেইখা মানব তৈরিতে নিজেদের উদ্দেশ্য ভুলে স্বর্গীয় সুরা পানের মাধ্যমে মনের ব্যাথা ভুলতে চেষ্টা করছেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন তারা
এক্টিভিস্ট
প্যারিস,ফ্রান্স