লক্ষ্মীছড়িতে সাঁওতালদের শ্মশানসহ ২০ একর সম্পত্তি দখলের অভিযোগ
খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দূর্গম এলাকা ২২০নং ময়ুরখীল মৌজায় সাঁওতালদের শ্মশানসহ ২০একর ভূমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। লক্ষ্মীছড়ি সদর ইউপির ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. রেজাউল করিমসহ ভূমিখেকো একটি চক্রের বিরুদ্ধে এসব ভূমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় নিরীহ গ্রামবাসীর অভিযোগ, বর্তমানে ভূমিখেকো চক্রটির অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে উপজেলার ময়ুরখীল মৌজার মহিষকাটা, সাঁওতালপাড়া, মোল্লাপাড়া এবং ছমুরপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার। প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে বারবার অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা।
প্রশ্ন উঠেছে ভূমিখেকো রেজাউল করিম (মেম্বার), তার সহযোগী জাকির হোসেনের খুঁটির জোর কোথায়?
গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো কেউ চক্রটির বিরুদ্ধে কথা বললে কখনো নারী দিয়ে শ্লীলতাহানী, কখনো নিজের শরীর নিজে রক্তাক্ত করে অন্যের নামে থানায় মামলা দায়ের করে ভূমি খেকো চক্রটি। এছাড়াও স্থানীয়দের নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অন্যের ভূমি জবর দখল, কেউ বাঁধা দিলে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে মিথ্যা-ভিত্তিহীন মামলা দিয়ে সহজ-সরল লোকদের জেল হাজতে বন্দিসহ নানাভাবে হয়রানী করে অতিষ্ট করে তুলেছে চক্রটি।
অভিযোগ রয়েছে, বাঙ্গালী, সাঁওতাল ও উপজাতীয় লোকদের জায়গা থেকে জোরপূর্বক গাছ কেটে বিক্রিসহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টাকারী এই ভূমিখেকো চক্রটির বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে জীবননাশের হুমকিসহ মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলে কিংবা এলাকা ছাড়া করার।
স্থানীয় মৃত রঞ্জন ভীমের ছেলে বাবুল ভীম ও নিলকন্টের ছেলে পবন ভীম (কার্বারী) অভিযোগ করেন, স্বাধীনতার পূর্ব থেকে সাঁওতালদের ৫০টি পরিবার তাদের দখলীয় ২০ একর সম্পত্তি ভোগ করে আসছে। জন্মের পর থেকে তারা লক্ষ্মীছড়ির ২২০নং ময়ুরখীল মৌজায় বিভিন্ন স্থানে খাস জমি দখলদার হিসাবে দীর্ঘদিন ভোগ দখল করে আসছে। এই ভূমিতে তাদের পিতা মাতাকে সমাধিত করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ভূমিখেকো চক্রের হাত থেকে এই শ্মশানটিও রক্ষা করা যাচ্ছে না। ২২০নং ময়ুরখীল মৌজার ৫১, ৫২, ৫৩নং হোল্ডিংয়ের বর্তমান মালিক দাবিদারগণ কোনদিনও ওই এলাকায় অবস্থান করেনি। কিন্তু মো. রেজাউল করিম মেম্বারসহ একদল ভূমিখেকো দফায়-দফায় আঞ্চলিক দলিল ও এভিডিভিট হলফনামা মূলে বিভিন্ন জনকে মালিক সাজিয়ে সাঁওতালদের দখলীয় সম্পত্তি বেচা-বিক্রি করছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশের সনামধন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গাজী গ্রুপসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এসব জমি ক্রয় করার উদ্দ্যোগ নিলে চক্রটি লোভে পড়ে এসব জমি বিক্রয়ের জন্য মালিকানা পরিবর্তন করে নিতে অসহায় সাঁওতালদের ওপর যার-যার পেশি শক্তি প্রয়োগ করছেন।
সাঁওতালরা বলছেন, ‘আমরা মামলা দিয়ে হেরে যাই। আমাদের কাছে কোনো প্রকার কাগজপত্র নাই। আমরা উক্ত জমি দীর্ঘদিন ভোগ দখল সূত্রে আবাদ করে আসছি।’
অসহায় সাঁওতালদের অভিযোগের ভিত্তিতে জেলার গুইমারা, মানিকছড়ি এবং লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা প্রেসক্লাবের সংবাদকর্মীরা সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। তারা দেখেন, ঐ গ্রামের কয়েকশত নারী-পুরুষ রেজাউল মেম্বার ও তার সহযোগী জাকির গংদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বিচারের দাবিতে মাঠে নেমে সহায়তা কামনা করেন সংবাদকর্মীদের কাছে।
এদিকে প্রশাসনের অসহযোগিতায় ক্ষুব্ধ এই মানুষগুলোর অভিযোগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দুর্নীতি ও জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থান থাকলেও লক্ষ্মীছড়ির ময়ুরখীলে ঘটছে তার উল্টোটা। প্রশ্ন উঠছে, স্থানীয় প্রশাসন কি তাহলে ভূমিখেকো চক্রটির কাছে অসহায়।
লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রেজাউল মেম্বার ও জাকির গংদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করে।
এদিকে ঘটনায় অভিযুক্ত রেজাউল মেম্বার ও জাকির হোসেন তাদের বিরুদ্ধে করা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে। তারা অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে বলে, ‘সাজানো লোকদের মিথ্যা ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে চাচ্ছে সরকার দলীয় লোকজন। রেজাউল করিম মেম্বার আরও বলেন, ‘আমি ক্রয় সূত্রে ৫১, ৫২, ৫৩নং হোল্ডিংয়ের মালিক। আমি সাঁওতালদের নামে উচ্ছেদ মামলা দিয়েছি। তারা আদালতে কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।’
অভিযুক্ত জাকির হোসেন জানান, ‘অভিযোগকারীরা আমাদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি এবং আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের দিয়ে জীবন নাশের চেষ্টা করেছে একাধিকবার।’
লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল চৌধুরী জানান, সাওতালদের জমি ও শ্মশান দখলের বিষয়টি নিয়ে অনেক আগ থেকে বিরোধ চলছে। বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য উপজেলা প্রসাশন ও স্থানীয়দের নিয়ে অনেকবার মীমাংসার জন্য বসার আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারণে বসা হচ্ছে না।
লক্ষীছড়ি থানা অফিসার ইনচার্জ মোঃ আব্দুল জব্বার জানান, জমিজমাকে কেন্দ্র করে সাঁওতালের সঙ্গে অন্য একটি পক্ষের বিভিন্ন মামলা মোকদ্ধমা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। বিষয়টি একাধিক মামলার কারণে আদালতে বিচারাধীন।
উল্লেখ্য, ২২০নং ময়ুলখীল মৌজায় মহিষকাটায় ভূমি সংত্রান্ত বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে বহু আগে থেকে। বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষ প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ এবং মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে আছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কয়েকটি সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি সাংঘর্ষিক আকার ধারণ করছে। যে কোন মহুর্তে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আশংকা করা হচ্ছে।