যে খাবারগুলো বাড়াবে শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষমতা
নিয়মিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার শিশু দৈহিক ও মানসিক বিকাশে সাহায্য করে। তবে এটাও ঠিক, একেক খাবারে থাকা পুষ্টি বেশি কাজে লাগে শরীরের একেক অংশে। বড়দের পাশাপাশি বিশেষ করে শিশুদের বেড়ে ওঠায় এসব খাবার অনেক বেশি ভূমিকা রাখে।
মস্তিষ্ক মানবদেহের অন্যান্য অংশের বিকাশ ও সঠিক পরিচালনা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করে। তাই শিশুকালেই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির উপযুক্ত বিকাশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
চলুন জেনে নেই মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়াতে সন্তানকে কোন খাবারগুলো খেতে দেয়া বেশি দরকার-
ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল বা কর্নফ্লেকস:
শিশুদের দিন শুরু করার ভাল একটি উপায় হলো এক বাটি সিরিয়াল দেওয়া। তবে সাবধান হতে হবে কারন বাচ্চারা যে সব সিরিয়াল পছন্দ করে বা খায় তার উপাদানের প্রায় ৫০ শতাংশ জুড়েই থাকে চিনি। এই সিরিয়ালগুলো অনেক বেশি প্রসেসিংয়ের মধ্য দিয়ে যায়। যার ফলে এগুলোতে ফাইবার, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে খুবই কম আর লবণ থাকে প্রচুর। ওইসব ক্ষতিকর সিরিয়াল বাদ দিয়ে কর্নফ্লেকস, উইটাবিক্স, গ্র্যানোলা, মিউজলি এবং পরিজের মতো সিরিয়ালগুলো খাওয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। আপনার সন্তান যদি তার এই সিরিয়ালের বাটিতে আলাদা চিনি মেশায়, তাও ওই চিনিভরা সিরিয়ালগুলোর চেয়ে অনেক অনেক কম চিনি থাকবে।
ডিম:
ডিম খাওয়া নিয়ে প্রায় শিশুদেরই নাই থাকে। তবে না খেতে চাইলেও শিশুকে প্রতিদিন অন্তত একটি ডিম খাওয়াতে চেষ্টা করতে হবে। কারণ গবেষণায় দেখা যায়, যারা প্রতিদিন অন্তত একটি ডিম খায় তাদের স্মৃতিশক্তি অন্যদের তুলনায় অন্তত ৭০% বেশি ভালো থাকে। ডিমে রয়েছে প্রচুর আয়রন। যা লোহিত কণিকা তৈরি করে রক্তের উপাদানে সঠিক মাত্রা বজায় রাখে। এতে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ হয়। যা চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা বাড়াতেও সাহায্য করে।
কিউই:
একটি কিউইতে একটি কমলার প্রায় দ্বিগুণ ভিটামিন সি থাকে, যা পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের একদিনের ভিটামিন সি’র চাহিদা পূরণে সক্ষম। ভিটামিন সি খাদ্য থেকে দেহে আয়রন শোষণের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি দেহে জমা থাকতে পারে না। তাই শিশুদের প্রতিদিনই কিউই বা ভিটামিন সি’তে ভরপুর অন্য খাবার খেতে দিতে হবে।
কলা:
কলা এমন একটি ফল, যাতে আছে প্রচুর পরিমাণে বলকারক কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা। সকালে নাস্তার কিছু সময় পর হালকা স্ন্যাক হিসেবে একটি কলা খেলে আপনার বাচ্চাটি পুরোটা সকাল জুড়েই তার শক্তি ধরে রাখতে পারবে। ফলে যে কোনো কাজে তার মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতাও বাড়বে। তাই টুকিটাকি স্ন্যাক হিসেবে সন্তানের ব্যাগে চিপস বা বিস্কিটের প্যাকেটের বদলে একটি কলা দিয়ে দিন।
শুকনো ফল:
যে সব ফল শুকিয়ে রাখা যায় সেগুলোতে থাকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। এগুলো হলো ব্যাপক শক্তির উৎস। তাই শিশুদের শুকনো ফল খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। তাহলে শিশুর মেধা বিকাশে অনেক প্রসারতা লাভ করবে। তাই মাদের উচিত চকলেট খেতে না দিয়ে শুকনা ফল দেওয়ার অভ্যাস করানো। এতে শিশুর দাঁতও ভাল থাকবে।
পনির:
ফ্যাট কম, ফাইবার বেশি – এ ধরণের খাদ্য গ্রহণের গাইডলাইন বড়দের জন্য, ছোটদের জন্য নয়। শিশুদের বর্ধিষ্ণু দেহের জন্য দরকার তুলনামূলক বেশি ফ্যাট ও কম শর্করা। এতে তারা দেহে বেশি শক্তি পায় এবং বিভিন্ন কাজ অনেক ভালোভাবে করতে পারে।
বাদাম:
শিশুকে প্রতিদিনই কয়েকটি করে বাদাম খেতে দিন। কারণ বাদামে রয়েছে ভিটামিন ‘ই’ যা মস্তিষ্কের সমন্বয় সাধনের ক্ষমতা বাড়ায়। কাজুবাদাম, পেস্তা বাদাম, চীনাবাদামসহ যে কোনো ধরনের বাদামই শিশুর মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়ক।
আখরোট:
মস্তিষ্কের জন্য আখরোট খুবই উপকারী। এতে বাদামের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। এটি শিশুসহ সব বয়সীদেরই মস্তিষ্কের যে কোনো রোগ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
ব্লু বেরি এবং স্ট্রবেরি:
ব্লুবেরি এবং স্ট্রবেরি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস বাচ্চাদের দক্ষতা ও চিন্তা করার ক্ষমতা উন্নত করে। এই খাদ্য মেমরি ক্ষমতা উন্নত করতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ভিটামিন সি এর উপস্থিতি ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে থাকে। এককথায় বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা বাড়াতে ব্লু বেরির জুড়ি নেই। তাই ব্লু বেরিকে ব্রেইনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর খাবার বলে ধরা হয়। সুতরাং শিশুর স্মৃতিশক্তি বাড়াতে এই খাবারগুলো দেওয়া উচিত।
ডার্ক চকলেট:
অভিভাবকরা সাধারণত শিশুদের চকলেট খাওয়া নিয়ে চিন্তিত থাকে। কিন্তু সব চকলেটই শিশুর জন্য ক্ষতিকর নয়। ডার্ক চকলেটে থাকে ৭৫% কোকো যা শিশুর মেধা ও বুদ্ধি বিকাশের জন্য উপকারী। ডার্ক চকলেট মস্তিষ্কে নিউরন তৈরি করে যা নতুন বিষয় মনে রাখতে সাহায্য করে। এটি শিশুর পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ায় এবং মস্তিষ্ক সতেজ রাখে।
জাম ও জামজাতীয় ফল:
শিশুর প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন জাম, লিচু, স্ট্রবেরি বা আঙ্গুরের মতো ফলগুলো। কারণ ফলগুলোতে রয়েছে এন্টি-অক্সিডেন্ট যা ব্রেইনের কোষের অক্সিডেশন এবং ক্রমাগত ক্ষয়ে
যাওয়া রোধ করে ব্রেইনের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
মায়ের দুধ:
শিশুকে অন্তত ছয় মাস বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। কারণ মায়ের দুধ পান করলে শিশুর বুদ্ধিমত্তা বাড়ে। ব্রাজিলের একদল গবেষক সাড়ে ৩ হাজার শিশুর ওপর দীর্ঘদিন নজর রাখার পর এ সিদ্ধান্তে আসেন।
শাকসবজি:
কিছু কিছু শাকসবজিও রয়েছে যেগুলো শিশুর মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। পাতা কপি ও পালং শাকে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন কে এবং বিটা ক্যারোটিন। যা শিশুর স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। পুষ্টিগুণে গুণান্বিত টমেটো। এটি মস্তিষ্কের শক্তি বৃদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই এখন থেকে প্রতিদিন শিশুকে রান্না, সালাদ নানাভাবে টমেটো খাওয়াতে চেষ্টা করতে হবে।
সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল:
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সামুদ্রিক মাছ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। মস্তিষ্কে থাকা ফ্যাটি এসিডের ৪০% হচ্ছে ডিএইচএ, যা সামুদ্রিক ও মাছের তেলে পাওয়া যায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হিসেবে। এই ধরনের যৌগিক উপাদান অন্য খাবারে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই শিশুর বয়স এবং দেহের গঠন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন খাওয়াতে চেষ্টা করতে হবে।
গম:
গমে রয়েছে ভিটামিন-ই ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস যা মস্তিষ্কের ক্ষয় প্রশমন করে ও হার্টকে ভালো রাখে। এর মধ্যে থাকা ফাইবার রক্ত থেকে ক্ষতিকারক কোলেস্ট্রেরল কমিয়ে দেয়। তাই প্রায় শিশুর জন্য গম দিয়ে খাবার তৈরি করে দেওয়া উচিত।
আভোকাডো:
আভোকাডো আমাদের দেশে সম্পূর্ণ নতুন একটি ফল। বিদেশি ফল হলেও এর বর্তমান প্রাপ্তি বেশ সুলভ বটে। এই ফল খেলে হার্ট ও মস্তিষ্ক, দুটিরই উপকার করে। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন ঠিক রেখে তার মেধার বিকাশ তীক্ষ্ণ করে তোলে। সুতরাং এই ফলটি শিশুর জন্য কম উপকারি নয়।
আমলকি:
আমলকিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস। ভিটামিন-সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া হার্ট ও মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখে। তাই দিনে ১-২টা করে আমলকী শিশুকে খেতে দেওয়া ভালো।
পেঁয়াজ:
এটি আমরা প্রায় সকলেই রোজ খাবারের সাথে রান্না করে বা কাঁচা খেয়ে থাকি। পেঁয়াজ হার্ট ও মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনকে বাড়িয়ে দেয়। তাই শিশুর খাবারে পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করতে চেষ্টা করবেন।
কালোজিরা:
কালোজিরাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস যা হার্ট বা মস্তিষ্ককে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায়। উচ্চ রক্তচাপ কমাতে, মনোযোগ বাড়াতে কালোজিরা সাহায্য করে। যদি কালোজিরা শুধু না খেতে চাই, তাহলে কিছু বিস্কুট আছে যেগুলো কালোজিরা দিয়ে তৈরি সেইগুলো খেতে দিতে চেষ্টা করবেন।
কালোজাম:
কালোজামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস যা প্রবল ক্ষতির হাত থেকে হার্ট ও মস্তিষ্ককে বাঁচায়। একইসাথে হার্টে রক্ত সঞ্চালনও বাড়িয়ে দেয় এই ফলটি। তাই শিশুর প্রতিদিন ১-২টা করে কালোজাম খেতে দিতে চেষ্টা করবেন।
লাল আপেল:
আপেলের খোসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস। এছাড়া এতে রয়েছে এমন উপাদান যা মস্তিষ্ককে ক্ষুরধার করার পাশাপাশি হৃদরোগের সম্ভাবনা কমায়। আপেল অনেক শিশু খেতে ভালবাসে, তাই শিশুকে আপেল খেতে দিবেন বেশি করে।
কুমড়োর বীজ:
কুমড়ো যেমন উপকারী তেমনই এর বীজে রয়েছে নানা খনিজ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যা কোলেস্ট্রেরলের মাত্রা কমায় ও মস্তিষ্ককে ক্ষুরধার করে তোলে। সুতরাং কুমড়োর বীজ না ফেলে দিয়ে শিশুকে ভেজে দিতে চেষ্টা করবেন।
মধু:
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপকারিতায় কোনও খাবার সম্ভবত মধুকে টেক্কা দিতে পারবে না। সব রোগের নিরাময় করতে মধু প্রয়োজন হয়। এতে রয়েছে নানা ধরনের ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ম্য়াগনেশিয়াম ইত্যাদি। ফলে হার্ট ও মস্তিষ্কের জন্যও মধু একইরকম প্রয়োজনীয়।