প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যাকান্ডের ১ বছর
একজন শাহজাহান বাচ্চু সাধারণের মধ্যে খুবই অসাধারণ ব্যাক্তি ছিল। আজ ১১ জুন ২০১৯ইং তার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। আমি কবি, লেখ, প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু গভীর শ্রদ্ধ্যার সাথে স্বরণ করছি। বাচ্ছু ভাই খু্ব স্পষ্টভাষী একজন মানুষ ছিলেন। কিছু দিন নিরাপত্তার জন্য ভারতে ছিলেন। পরবর্তীতে ভারত থেকে চলে আসেন।
তিনি জানতেন তার উপর হামলা হতে পারে, তবুও সাহস করে থেকে গেছেন বাংলাদেশে। অনেকের মানা করার পরও দেশত্যাগ করেন নি। এই সাহসীকতার পুরুস্কার স্বরূপ তাকে সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে প্রান হারাতে হলো।
সেদিন ১১ জুুুন ২০১৮ ইং তে প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যাকান্ডের খবরটি যেভাবে এসেছিল তার সারাংশ হলো।
রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সিগঞ্জে কবি, প্রকাশক ও রাজনীতিবিদ শাহজাহান বাচ্চুকে (৫৭) গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। জেলার সিরাজদিখানের মধ্যপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম কাকালদি গ্রামে সোমবার (১১জুন ২০২৮ইং) সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে।
সিরাজদিখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “হেলমেট পরা দুর্বৃত্তরা দুটি মোটরসাইকেলে করে এসে প্রথমে দুই-তিনটি ককটেল ফুটিয়েছে, তারপর তারা একটিই গুলি করেছে।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মুন্সিগঞ্জ জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাচ্চু ‘নাস্তিক’ ও ‘মুক্তমনা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলেন তাঁর স্বজন-বন্ধুরা জানিয়েছেন।
ঘটনাটিতে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাঁরা ধারণা করছেন মতাদর্শের কারণে বাচ্চু হত্যার শিকার হয়ে থাকতে পারেন। রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এর মধ্যেই তাঁদের একটি দল মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা করেছে।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে গতকাল একাধিক গণমাধ্যম বলেছে, একটি ঔষধের দোকানে বসে ছিলেন শাহজাহান বাচ্চু। হঠাৎ মোটরসাইকেল করে আসা দুই ব্যক্তি দোকানে ঢুকে তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে দোকান থেকে বের করে।
একপর্যায়ে ওই এলাকার রাস্তায় বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। পরে শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে ওই দুই ব্যক্তি মোটরসাইকেলে উঠে পালিয়ে যায়।
স্থানীয় লোকজন অচেতন অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। তবে চিকিৎসা কর্মকর্তা দুলাল আহম্মেদ সাংবাদিকদের বলেন, “স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার আগেই বাচ্চুর মৃত্যু হয়েছে।”
সোমবার রাত ১১ টা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ওসি কালাম বলেন, “লাশ ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”
“কেবলই কবিতার বই প্রকাশনার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৯৩ সালে যাত্রা শুরু করেছিল তাঁর বিশাকা প্রকাশনী। ওই প্রকাশনী থেকে এখন পর্যন্ত সাত শতাধিক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে,” জানান নিহতের মেয়ে ব্লগার দূর্বা জাহান।
দূর্বা বলেন, “আজীবন কবিতা লিখলেও তাঁর একটাই বই, নাম ‘রঙ ঢঙ তামাশা। তিনি মূলত অন্যের বই পাবলিশ করেই গেছেন।”
শাহজাহান বাচ্চুর নাম উগ্রবাদীদের হিট লিস্টে ছিল বলে জানিয়েছেন সিপিবির মুন্সীগঞ্জ জেলার সভাপতি শ ম কামাল।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “ছাত্র জীবনে বাচ্চু ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, ২০১২-১৪ সময়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তবে বর্তমানে পার্টির কোনও পদে নেই।”
এছাড়া সাপ্তাহিক আমাদের বিক্রমপুর পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও ছিলেন নিহত শাহজাহান বাচ্চু।
শাহজাহান বাচ্চু (৫৭)। ছবিটি তাঁর ফেসবুক থেকে নেয়া। বেনারনিউজ ছিলেন উগ্রবাদীদের হুমকিতে
ওসি কালাম বেনারকে বলেন, “নিহতের পরিবার বলছে তাঁদের সাথে কারও কোনো শত্রুতা নেই। কোনো ধরনের হুমকি পাওয়ার কথাও তারা কিছু বলেনি আমাদের।”
“কে বা কারা কী কারণে শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যা করেছে সে ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে তদন্ত শুরু হয়েছে,” যোগ করে তিনি আরও বলেন, “আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে।”
তবে লেখালেখির কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বিভিন্ন সময় তাঁকে হুমকি দিয়েছে বলে এর আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন বাচ্চু।
২০১৫ সালে যখন জঙ্গিরা একের পর এক ব্লগার, লেখক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করছিল, তখন বাচ্চুও জঙ্গিদের হুমকি-ধমকি পেতেন। ওই সময় জীবন রক্ষায় তাঁকে বাড়িও ছাড়তে হয়েছিল বলে ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন বাচ্চু।
“প্রথম দিকে আমি ওসব হুমকিকে পাত্তা দেইনি, ভেবেছি ওইসব অচেনা বদমাশদের কথায় কান দেওয়া অর্থহীন। কিন্তু ওয়াশিকুর রহমান বাবু ও অনন্ত বিজয় হত্যার পর বিষয়টাকে আমি গুরুতর হিসেবে দেখতে শুরু করি। মূলত আমার পরিবার খুব ভয় পেয়ে যায়,” ২০১৫ সালের আগস্টে অবজারভারকে বলেন বাচ্চু।
গুটিয়ে ছিলেন বাচ্চু
মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. জাহেদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, “শাহজাহান বাচ্চু মূলত ঢাকায় থাকতেন। মাঝে মাঝে মুন্সিগঞ্জে আসতেন।”
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ব্লগার দূর্বা বেনারকে বলেন, “গত দেড় দুই বছর ধরে তিনি ঢাকায় থাকেন না, মূলত গ্রামেই থাকতেন। তবে মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন।”
এসপি ফোন করে ঢাকার বাসার ঠিকানা নিয়েছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “বাবা ইদানীং তেমন কিছুই করতেন না। স্রেফ ঘুরে বেড়াতেন। প্রকাশনীর সব কাজ থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।”
এ ঘটনা চাউর হওয়ার পর ফেসবুকে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে লিখছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ইষ্টিশন ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা নূর নবী দূলাল লিখেছেন, “হত্যার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে চাপাতির চেয়ে গুলি করে হত্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।”
বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্ত চিন্তার লেখকদের জন্য নিরাপদ নয় তা শাহজাহান বাচ্চু হত্যা কান্ডের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের প্রশাসন নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ।
মোঃ শামসুল আরিফ
লেখক ও প্রকাশক
www.praner71news.com
ফ্রান্স