চীনে দেখে আসা করোনাভাইরাসের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন চার মার্কিনি
চীনে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রথম সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং। তবে তার কথাকে গুজব হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংকে আটক করে হুমকিও দেওয়া হয়।
বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৩৫৭ জন মারা গেছেন এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। দুঃখের বিষয় এই যে, চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সেই ঘটনার জেরে চীন সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভও জমেছে মানুষের মনে। বিষয়টি তদন্তের আশ্বাস এসেছে।
এদিকে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিক থেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। এরই মধ্যে ২৪টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাস।
চীন থেকে অন্য দেশের নাগরিকদের মতো মার্কিনিদেরও ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ফিরে যাওয়ার পর নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন মার্কিনিরা।
তারা বলছেন, উহানে থাকা অবস্থায় করোনাভাইরাস সম্পর্কে সেভাবে তথ্য পাচ্ছিলেন না। চীন সরকার সেভাবে তথ্য প্রকাশ করেনি এবং এক ধরনের সীমানা নির্ধারণ করে রেখেছে। অন্যদিকে সারাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তো রয়েছেই।
করোনাভাইরাস গত ছয় সপ্তাহ ধরে বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে থাকার পর উহান থেকে ফিরে আসা চার মার্কিন নাগরিক নতুন কিছু তথ্য সামনে নিয়ে এসেছেন। তাদের বয়ান –
রবিবার, ৫ জানুয়ারি ২০২০
জন ম্যাকগোরি উহানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ভাইয়ের কাছ থেকে এই ভাইরাসের তথ্য পান তিনি। অজানা ওই ভাইরাসে তখন বেশ কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন বলে তিনি খবর পান। ওহিও ফিরে যাওয়ার আগে তিনি কম্বোডিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি
মার্কিন গবেষক দিয়ানা আদামা ১৪ বছর ধরে চীনে ছিলেন। উহান থেকে ফিরে যাওয়ার পর জ্বর আসে তার। এরপর হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করেন। ডাক্তাররা তাকে জানান, ব্রংকাইটিস হয়েছে। এটা জেনে সপ্তাহখানেক তিনি হাসপাতালে ছিলেন।
বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি
চীনে প্রথম একজনের মৃত্যুর খবর আসে। যদিও সরকারিভাবে ওই ব্যক্তি মারা যাওয়ার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল কয়েকদিন পরে।
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি
ইলোনা এবং ক্লদ ব্লুইন দম্পতি উহানে গিয়েছিলেন তাদের ছেলের কাছে। সেখানে তাদের ছেলে গণিতে অনার্স পড়েন।
সোমবার, ২০ জানুয়ারি
ম্যাক গোরি বলেন, এক ব্যক্তি হঠাৎ করেই দাঁড়ানো ট্রেন থেকে নেমে লোকজনদের সতর্ক করে বলেন, ওই ট্রেন থেকে যেন সবাই নেমে যায়। তাছাড়া যে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। প্লাটফর্মের মানুষজন অল্প সময়ের মধ্যেই যে যার মতো চলে যায়।
বুধবার, ২২ জানুয়ারি
ম্যাক গোরির স্কুলে অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। সেখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকার কথা। তবে হুট করেই সেই অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়া হয়। তবে, সবাইকে মাস্ক, হ্যান্ডওয়াশ এবং প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস প্যাকেট আকারে দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি
ঘুম থেকে উঠেই ম্যাক গোরি বুঝতে পারেন, অনেকটাই অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি বাজার-সওদা করতে যান। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সেভাবে কোনো পণ্য পাননি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই পণ্যের মজুত শেষ হয়ে যায়।
উহান থেকে সব ধরনের ফ্লাইট বাতিল করে দেওয়া হয়। ট্রেনসহ সব ধরনের গণপরিবহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, সরকারের পরিকল্পনা- বিমান থেকে জীবাণুনাশক ফেলা হবে। কিন্তু পরে তা হয়নি।
ইলোনা বলেন, অন্তত ১০ দিন ঘরে বন্দি ছিলাম। বারবার ভেবেছি কখন বাড়ি ফিরে যেতে পারবো। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো তথ্যই পাচ্ছিলাম না। আর আদামা বুঝতেই পারেননি যে, শহরটি অবরুদ্ধ করে রাখা আছে।
শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি
নিউ ইয়ারস ইভ পালন করেননি ম্যাক গোরি। তিনি বলেন, কেউই সেভাবে বাইরে বের হয়নি। ৩৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্তের শঙ্কায় বাইরে বের হতে বারণ করেছিল চীন সরকার।
শনিবার, ২৫ জানুয়ারি
আদামা বাইরে বের হয়ে হাসপাতালে যান। পথে তিনি একটি ভিডিও করেন। তাতে দেখা যায়, রাস্তায় কোনো প্রাইভেট কার নেই, বাস নেই, কোনো যানবাহনই নেই। আমাদের কাছে কোনো তথ্যও নেই, কেউ কিছুই বলতে পারছে না।
সন্ধ্যায় কয়েকজনের সঙ্গে বের হয়ে রাতের খাবার খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটাও পরে বাতিল হয়ে যায়।
রবিবার, ২৬ জানুয়ারি
আদামা জানতে পারেন যে, উহান শহর একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখা আছে।
সোমবার, ২৭ জানুয়ারি
ম্যাকগোরির বিশ্ববিদ্যালয় স্প্রিং সেমিস্টার বন্ধ রেখেছে। ওদিকে চীনে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস থেকে তাকে ফোন করা হয়। এরপর বলা হয়- উহান থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য চাইলে বিমানের একটি টিকিট নিতে পারেন।
বুধবার, ২৯ জানুয়ারি
বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যরাও ভয়ের মধ্যে আছে। মানুষজন বুঝতে পারছে না কী ঘটছে। অন্যদের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বললেও উত্তর আসছে না। শেষ পর্যন্ত দুঃশ্চিন্তা কাটছিল রা।
এরপর অনলাইনে এ ব্যাপারে ওয়েবসাইট চালু করেন তিনি। তারপর প্রশ্ন রাখেন, উহানে কী ঘটছে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না। কেউ জেনে থাকলে সে ব্যাপারে তথ্য দিতে।
এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আদামার ঘরে পৌঁছে দেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। তার চোখেমুখেও ভয়ের ছাপ।
বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি
আদামা বলেন, সবাই চিন্তিত। এরই মধ্যে আমরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি চ্যাট গ্রুপ চালু করি। তাতে কেউ বলছেন, কয়েক মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে অজানা ভাইরাসে। আবার কেউ বলছেন, রসুন পিষে পানিতে সেদ্ধ করে খেলে এই ভাইরাস সেরে যাবে।
শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি
এরই মধ্যে সাংবাদিক থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা হয়েছে ম্যাক গোরির। চাপ কমাতে কয়েকজন একসঙ্গে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া এবং বারে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু হোটেল ও বার বন্ধ।
এর পরদিনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পক্ষ থেকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারি
দূতাবাস থেকে ফোন করে টিকিট নেওয়ার কথা জানানো হয় ম্যাক গোরিকে। খবর পেয়ে আদামা মাস্ক এবং টিস্যুব্যোগে ভরে রাখেন। তবে হাতমোজা কিনতে পারেননি তিনি।
পাশের দোকান থেকে ভিটামিস সি কিনে নেন তিনি। তবে কেন কেনেন, সে ব্যাপারে খোলাসা করে বলেননি। ওইদিন তেমন কারো সঙ্গেই দেখা হয়নি আদামার।
রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি
ম্যাক গোরির ফ্লাইট ৩৬ ঘণ্টার জন্য স্থগিত হয়ে যায়। ওই অবস্থায় আদামা নিজের জন্মদিন পালন করেন, সেটাও একা একা। অথচ এর আগে এরকম ঘটেনি কখনো।
মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি
৪০ মাইল পাড়ি দিয়ে বিমানবন্দরে যান ম্যাক গোরি। তবে বিমান বন্দরের কোনো কর্মী তাকে স্পর্শ করেননি। টেবিলে রাখা পাসপোর্টের দিকে কেবল নজর দিয়েছেন। ১৫ ঘণ্টা সেখানে অপেক্ষা করেন তিনি।
দুটি বিমানে ৩৫০ জন মার্কিনিকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। ম্যাক গোরি বলেন, অনেক যাত্রীর পরিবারের সদস্যরা অন্য বিমানে ছিল। জানালা দিয়ে দেখার কোনো উপায় ছিল না। বিমানের ক্রুরা স্যুট পরে ছিল। কারো সেভাবে কোনো কথাও হচ্ছিল না। সবাই একটা দূরত্ব বজায় রাখছিল।
এরপর তাদের নিয়ে গিয়ে রাখা হয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে। ১৪ দিন ধরে সেখানে সবাইকে পর্যবেক্ষণে রাখার কথা।
সূত্র : ইউএসএ টুডে