প্রাণের ৭১

ব্রিটিশ ভারতের প্রখ্যাত বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের ৮৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ

ব্রিটিশ ভারতের প্রখ্যাত বিপ্লবী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনসহ বহুবিধ বিপ্লবের অধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের ৮৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ। মাস্টারদার পুরো নাম সূর্য কুমার সেন। সংক্ষেপে সূর্যসেন নামে অধিক পরিচিত। তবে মাষ্টার দা নামে সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিলেন।

১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। সূর্য সেনকে ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী মধ্যরাতে চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় অর্থনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজমনি সেন এবং মাতার নাম শশী বালা সেন। রাজমনি সেনের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সূর্য সেন তাঁদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। দুই ছেলের নাম সূর্য ও কমল। চার মেয়ের নাম বরদা সুন্দরী, সাবিত্রী, ভানুমতি ও প্রমিলা। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমণি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন। সূর্য সেন ছেলেবেলা থেকেই খুব মনোযোগী ছাত্র এবং ধর্ম ভাবাপন্ন গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। সূর্যসেনের প্রথম স্কুল ছিল দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সূর্য সেন ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে এফএ-তে ভর্তি হন। সে সময় আইএ বা বর্তমানের এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে ফার্স্ট আর্টস বা এফএ পরীক্ষার নিয়ম ছিল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সূর্যসেন এফএ পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করেন।

১৯১৮ সালে তিনি বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন এবং চট্টগ্রামে ফিরে এসে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারের বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত ‘উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ অংকের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এসময় বিপ্লবী দলের সাথে তাঁর সম্পর্ক গভীরতর হয়ে ওঠে এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টারদা’ হিসেবে পরিচিত হন।

বিপ্লবী ভাব ধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বিবাহ-বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে আসার পর থেকেই তাঁর বিবাহের কথাবার্তা অভিভাবকরা তোলেন। অবশেষে তাঁর বড় ভাই শিক্ষক চন্দ্রনাথ সেন (সহোদর নয়) ও অন্যান্য আত্মীয়দের বিশেষ অনুরোধে ১৯১৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের ষোল বছরের কন্যা পুষ্প দত্তকে বিয়ে করেন। আত্মীয়-স্বজনের চাপে বিয়ে করলেও মাস্টারদার মনে এ ধারণা বলবৎ ছিল যে, বিবাহিত জীবন তাকে কর্তব্য ভ্রষ্ট করবে, আদর্শচ্যুত করবে। তার ফলে স্ত্রীর সংগে একদিন তিনি কথা পর্যন্ত বলেন নি। বিবাহের তৃতীয় দিনে হিন্দুদের মধ্যে যে ফুলশয্যায় প্রথা প্রচলিত আছে, সেদিন তিনি তাঁর বৌদিকে বলেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন স্ত্রীর সংগে সহবাসে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি সেদিনই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসেন। সূর্য সেন ১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন। বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি এই কলেজ়ে তিনি অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। সূর্য সেন ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন।

৪৯নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের নগেন্দ্রনাথ সেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে এসে সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারুবিকাশ দত্তের সাথে দেখা করেন। সূর্য সেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অম্বিকা চক্রবর্তী একই থানার পাশাপাশি গ্রামের ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পরস্পরের কাছে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, শুরুতে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দল একটিই ছিল। তারা বাংলার প্রধান দু’টি বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’ এবং ‘অনুশীলন’- কোনটির সাথে একেবারে না মিশে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। বিপ্লবী নেতা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী তখন চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুরপারে ‘সাম্য আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে ওখানে থাকেন। সেখানে গোপনে বিপ্লবীরা জমায়েত হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম নেতা চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে অনুশীলন দলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। এভাবে চট্টগ্রামেও বাংলার অন্যান্য জেলার মত দু’টি বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে। চট্টগ্রামে যে বিপ্লবী দলটি

নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে কংগ্রেসের প্রকাশ্য আন্দোলনে কোলকাতার যুগান্তর দলের সঙ্গে সহযোগিতা করত, সে দলের সাংগঠনিক সভাপতি ছিলেন সূর্য সেন।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী স্বরাজ এনে দেওয়ার জন্য বিপ্লবীদের কাছ থেকে এক বৎসরের সময় চেয়ে নেন। তৎকালীন বিপ্লবীরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী না হলেও গান্ধীর কথায় অনেকেই সহযোগিতা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অহিংস আন্দোলন এক বৎসরের ভেতর ভারতের স্বরাজ আনতে ব্যর্থ হলে বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় সূর্যসেন একটি জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। এ বিদ্যালয়ে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা প্রত্যাখান করে নিজস্ব পড়াশোনা করানো হতো। বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। এভাবেই তিনি খ্যাত হন মাস্টারদা নামে। এই বিদ্যালয়টিই পরে তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরে একপ্রান্তে বাটালি পাহাড় এলাকায় সরকারি রেলের টাকা লুণ্ঠন করে। এই লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন অনন্ত সিং, দেবেন দে ও নির্মল সেন। অম্বিকা চক্রবর্তী ও দলিলুর রহমান রেল ডাকাতির সতের হাজার টাকা নিয়ে অস্ত্র কেনার জন্য কলকাতায় চলে যান। সে সময় সুলুক বাহার এলাকায় ছিল বিপ্লবীদের সদর দপ্তর। ২৪ ডিসেম্বর এই দফতরে পুলিশ হানা দেয়। এখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হলেও তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তারা প্রথমে নগরকানা পাহাড়ে আশ্রয় নেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলে মাস্টারদা, অম্বিকা চক্রবর্তী ও রাজেন দাস তাঁদের পকেটে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। অন্যান্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেই মৃতপ্রায় মাস্টারদা ও অম্বিকা চক্রবর্তী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। উল্লেখ্য এঁরা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছিলেন, কিন্তু ভালো থাকার সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ার কারণে কার্যকারিতা হারিয়েছিল। ফলে এই তীব্র বিষ খেয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন। পরে পুলিশ হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসার পর তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকাতির মামলা রুজু করেছিল । যতীন্দ্র মোহন এই মামলা পরিচালিত করেন এবং প্রায় ৯ মাস কারাবন্দী থাকার পর মামলা থেকে তাঁরা খালাস পান। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্রলুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মাস্টারদার নাম শোনা যায়। এই কারণে ১ নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স ঘোষণা করে সারা বাংলায় বিপ্লবীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করা হোক। শুধু ২৫ অক্টোবর তারিখেই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০০ বিপ্লবী কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় গ্রেফতার হন নেতাজী সুভাষ, অনিলবরণ রায় প্রমুখ নেতারাও।

চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে মাস্টারদা কলকাতা শোভাবাজার আশ্রয় নেন। ওই সময় তাঁরা কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ নিতেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর সেখানে পুলিশ হানা দেয়। সূর্যসেন গায়ের জামা খুলে খালি গায়ে একটা অপরিষ্কার ময়লা গামছা কাঁধে ফেলে চায়ের কেতলি হাতে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন। পুলিশ তাঁকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সাদাসিধেভাবে বলেন, বাবু লোকদের জন্য চা আনতে যাচ্ছেন। পুলিশের দারোগা কিছুক্ষণ জেরা করার পর সন্দেহ করার মতো কোনো কিছু না পেয়ে তাঁকে ছেড়ে দেন।

এর প্রায় একবছর পর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ‘মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা। এ মামলায় ১৯২৮ সাল পর্যন্ত দুইবছর তাঁকে মেদিনীপুর প্রেসিডেন্সি জেল, পুনার রায়েরোড়া জেল ও বম্বের রত্নগিরি জেলে কারাবাস করতে হয়। ১৯২৮ সালের শেষের দিকে তাঁর স্ত্রী পুষ্প কুন্তলার অসুস্থতার খবর পেয়ে সূর্যসেন তাকে দেখতে আসার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই আবেদন মঞ্জুর করা হলে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু তাঁকে নজরবন্দী রাখা হয়। বাড়ি পৌঁছার দিনে তাঁর স্ত্রী পুষ্প কুন্তলা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলেন। তিন মাস শয্যাশায়ী থাকলেন। এই সময় একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য পরামর্শ দেন এবং এর বিনিময়ে সংসারের খরচ ব্রিটিশ সরকার চালাবে বলে জানানো হয়। সূর্যসেন এর কোনো উত্তর দেন নি।

সূর্যসেনের দাদা চন্দ্রনাথ সেন বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে সময় চেয়ে নেন। এরপরই সূর্যসেন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান। নিজেকে আত্মগোপন করে সূর্যসেন তার বিপ্লবী দলকে সংগঠিত করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। এর চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ এপ্রিলে। মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। এই সময় তাঁদের পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোষাক। তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন কয়েকটি রিভলবার এবং সাধারণ বন্দুক।

অস্ত্রাগার ভেঙে তাঁরা বেশ কিছু মাস্কেট্রি রাইফেল, রিভলবার এবং কার্তুজ লাভ করেন। এই আক্রমণের শুরুতেই তাঁরা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিলেন। ফলে আক্রমণের সময়, ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শহরের অন্য প্রান্তের সৈন্যদের কাছে এই আক্রমণের যথার্থ সংবাদ পাঠাতে ব্যর্থ হয়। এই সময় বিপ্লবীরা এত দ্রুত আক্রমণ করে অস্ত্রাগার দখল করে নেন যে, সার্জেন্ট ব্লাকবার্ন, কলোন, সার্জেন্ট মেজর ফেরেল-সহ অনেক অফিসার প্রতিরোধ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।

এ ঘটনার পর সূর্য সেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাঁদের আক্রমণ করে। দুই ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হয়। জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের ধরার জন্য রেলস্টেশন, স্টীমারঘাট হতে শুরু করে সব স্থানে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করে ব্রিটিশ বাহিনী। ১৯৩০ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্য সেন-এর নির্দেশে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিলেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

ইংরেজ প্রশাসন সূর্য সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে সেখানে এক বৈঠকে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। রাত প্রায় ১০টার দিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনী ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে গুলি বিনিময় করে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত আর সুশীল দাসগুপ্ত পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। সূর্যসেনের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মামলা দাড় করিয়ে বিচার শুরু হয়।

১৪ আগষ্ট ১৯৩৩ সালে মামলার রায় ঘোষনা করে ব্রিটিশ সরকার এবং ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অস্তমিত হয় এক ইতিহাস। শেষ দিনগুলো: কনডেম্ড সেলে সূর্য সেনকে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরীতে রাখা হত। একজন কয়েদি মেথর সূর্য সেনের লেখা চিঠি ময়লার টুকরিতে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসতো।

মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা”। তিনি স্মরণ করেন তাঁর স্বপ্নের কথা–স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন যার জন্য জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত তিনি ছুটেছেন। তাঁর ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো”। তিনি সংগঠনে বিভেদ না আসার জন্য একান্তভাবে আবেদন করেন । শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় তাঁর একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হল। সেই সময় জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। রাত ১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাঁকে চিৎকার করে বলেন “এই বিনোদ, এই বিনোদ, দরজার কাছে আয়। মাষ্টারদা গান শুনতে চেয়েছেন”। বিনোদ বিহারী গান জানতেন না। তবুও সূর্য সেনের জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কয়েক ঘণ্টা আগে মাস্টারদা সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এতে তিনি লিখেছিলেন- আমার শেষ বাণী – আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার বন্ধু রূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার এই তো সময়। কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্র্যহীন আমার এই জীবনের একঘেয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা

আমরা বন্ধুরা – এগিয়ে চল, এগিয়ে চল – কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদিমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো। আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে– এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর হবার কথা উল্লেখ করা হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর সূর্য সেনের লাশ ছুয়ে স্বাধীনতার জন্য শপথ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার দলের অনেক সদস্যই । কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সূর্যসেনের লাশটিও দেয়নি। কারণ তারা ভেবেছিলেন, সূর্যসেনের মৃতদেহ লড়াই-সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, তাই লাশটিকে গুম করে ফেলে। সূর্য সেন কে এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মম ভাবে অত্যাচার করে। ব্রিটিশরা হাতুরী দিয়ে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দেয় এবং তাঁর হাড় ও ভেঙ্গে দেয়। হাতুরী দিয়ে নির্মম ভাবে পিটিয়ে অত্যাচার করা হয়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি। ফাঁসীর পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে … স্বাধীনতার পতাকা হাতে সাম্য মুক্তির জন্য যাঁরা লড়ছেন কাজ করছেন – তাঁদের চেতনায় মাস্টারদা সূর্যসেন অমর হোন, চিরজীবী থাকুন। মৃত্যু বার্ষিকীর এই দিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*