প্রাণের ৭১

আওয়ামী লীগ মানেই সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি-মোহাম্মদ হাসান

‘বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ’ ইতিহাসে এই তিনটি নাম অমলিন, অবিনশ্বর। ইতিহাসে এই তিনটি নাম একই সূত্রে গাঁথা। আওয়ামী লীগ মানেই দেশের স্বাধীনতা, স্বাধীন মানচিত্র, স্বাধীন পতাকা। তেমনি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য ও অর্জনের নামও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী গণমানুষের প্রিয় দল আওয়ামী লীগের কাল ২৩ জুন প্রতিষ্ঠার দিন।

আওয়ামী লীগ মানেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের মূল ধারা। আওয়ামী লীগ মানেই সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের কাদা-মাটি গায়ে মাখা খেটে খাওয়া মানুষের কাফেলা। অতীতের মতো বাংলাদেশের ভবিষ্যতও আওয়ামী লীগের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। বাঙালী জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেয়া উপমহাদেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আগামীকাল ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ যারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা তাদের আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ঐতিহাসিক ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাগণ দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দল। যদিও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই ’৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে প্রাণপ্রিয় ছাত্রপ্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই বছরের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পথে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সংগঠিত করে বাঙালির ইতিহাসে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এই তিনটি নাম সমার্থক হয়ে আছে।

আওয়ামী লীগের ইতিহাস অবিরাম পরিবর্তন ও বিপ্লবের ইতিহাস। ’৫৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ২২৮টি আসনে জয়লাভ কার্যত মুসলিম লীগের কবর রচনা করে এবং রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সাম্প্রদায়িকতা বিদায় করার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ফলাফল, ’৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ’৫৫-এর ২১ অক্টোবর হয় অসাম্প্রদায়িক ‘আওয়ামী লীগ’। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ‘বজ্র কঠিন শপথ’ চেতনায় ধারণ করে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পথচলা। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ’৬২তে আমাদের স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। ’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়েছিলেন লাহোরে। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ’৬৬-এর ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বলতেন ‘সাঁকো দিলাম, এই সাঁকো দিয়েই একদিন আমরা স্বাধীনতায় পৌঁছাব।’

’৬৯-এর গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির যে জাগরণ ও বিজয় সূচিত হয়, সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ এবং এই আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি জাতি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শুন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এর পর দলের মধ্যে ভাঙনও দেখা দেয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে তার স্বপ্নে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ। দেশজুড়ে গণহারে গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। প্রাচীন এই সংগঠনকে ভেঙে ছিন্নভিন্ন করতে নানা কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র চালায় পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী। শত শত মিথ্যা মামলার জালে জড়ানো হয় প্রবীণ ও নেতৃত্বদানকারী নেতাদের। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলায় সৃষ্টি করা হয় সেনানিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ধারার। আর সুকৌশলে চালানো হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা।

১৯৮১ সালের ১৭ মে আবেগ-আশ্রয়ী বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। মূলত সেদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বুননে নতুন করে হাল ধরেন শেখ হাসিনা। মাঝপথে এসে থমকে যাওয়া আওয়ামী লীগ আবারও যেন নতুন প্রাণ পায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে শেখ হাসিনা পা রেখেছিলেন। এর আগেও কয়েকবার বিদেশের মাটি থেকে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন তিনি।

এ দিনটা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ, অনন্য একটা দিন। অস্থির বাংলাদেশে তখন বাঙালি জাতি ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের দখলদারি ও জবরদস্তি শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট, বুটের তলায় স্তব্ধ তাদের অধিকার। অবরুদ্ধ ছিল বাকশক্তি। বাংলাকে পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত পেয়ে বসেছিল পাকিস্তানপ্রেমী শাসকচক্রের। সেদিন দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বপ্নের সোনার বাংলা পাননি শেখ হাসিনা।

পাহাড়সম বাধা আর পথের বাঁকে বাঁকে বিছানো ছিল বিরুদ্ধাচরণ-বিপত্তির কাঁটা। এ কাঁটার ভয় উপেক্ষা করে তিনি ফিরেছিলেন বাংলায়, সমবেত হয়েছেন জনতার কাতারে। মানুষের ভালোবাসা ও আস্থার ওপর ভরসা রেখে তিনি সব ঝুঁকি উপেক্ষা করেছিলেন সেদিন। ভালোবাসা, আবেগের বিবেচনায় এ দিনটি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে যেমনটি স্মরণীয়, তেমনি মুক্তিকামী বাঙালির ইতিহাসে ১৭ মে দিনটি নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। দীর্ঘ বিরতির পর ওইদিন থেকে আবারও যেন হাঁটা শুরু করে আওয়ামী লীগ।

গণমানুষের পাশে থাকা প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ দলটির নেতৃত্বেই এদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। রোজগার্ডেনে জন্মগ্রহণের পর থেকে নানা লড়াই, সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়।

আবার ৭১ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ বছর, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে।

২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর অনেকটা সুসংহত হতে সক্ষম হয়ে জোটসরকার বিরোধী আন্দোলনে সফলতার পরিচয়ও দিয়েছিল দলটি। কিন্তু এই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে আবারো নতুন সংকটের মুখে পড়ে যায় দলটি। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ প্রথম সারির অসংখ্য নেতারা গ্রেফতার এবং একাংশের সংস্কার তৎপরতায় কিছুটা সংকটে পড়ে দলীয় কার্যক্রম।

তবে, সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।

পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে নির্বাচনের বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং তৃতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী হন।

২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ইতোমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছি। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেন নাই। সেই কাজটি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা করে চলেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা সেই পথেই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে দেশ।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*