আসল রাজনীতিবিদ সৃষ্টি না হওয়ায় তৈরি হচ্ছে ভূইফোঁড় রাজনীতিবিদ-মোহাম্মদ হাসান
যে রাজনীতিই আমাদের সব দিয়েছে। কিন্তু সে রাজনীতিই এখন বিরক্তি ও বিড়ম্বনার কারণ।
গত শতাব্দীর বড় অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে সততা ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতির হাত ধরে। গত শিকি শতাব্দি ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি তার পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থা থেকে সরে এসে বাণিজ্যনির্ভর হয়ে পড়েছে। যার প্রেক্ষিতে রাজনীতির কিছু আদর্শ স্লোগান বিজ্ঞাপনী ভাষাতে রূপান্তরিত হয়েছে। সকল পর্যায়ে অযাচিত রাজনীতির ব্যবহার ও খবরদারিতে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় শ্লীল-সুন্দর ব্যবস্থায় অশ্লীলতা ভর করে দেশ সুদ্ধ জনগণের কাছে ঘৃণা ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনজীবনকে উন্নত করার বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে জনপরিসরে বিতর্ক আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ কেন ভোটের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে ফেলেছে, সেই প্রশ্নের আপাতত কোনো সুরাহা দেখছি না। আমাদের ভাবা উচিত, এই নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে ঠিক কী অপেক্ষা করছে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। আমাদের ভাবতে হচ্ছে আগামীতে কোন মানুষ রাজনীতিতে আসবে, তারা কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করবে, তাদের রাজনৈতিক আচরণ কতোটা রাজনৈতিক আর কতোটা সুবিধা আহরণকেন্দ্রিক হবে ইত্যাদি। রাজনীতির মাধ্যমেই সরকার গঠন হয়। সরকার সবার, তাই রাজনীতিতে সব শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। কিন্তু বলা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে নাকি উচ্চ শ্রেণির হাতে বন্দি হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে, কারণ এখন এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ব্যবসায়ী আর সাবেক আমলাদের হাতে। তাই নির্বাচনে দরিদ্রের অংশগ্রহণের কথা আসে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এমন চিত্র কোনো আশার আলো সঞ্চার করে না। ফলে যে সম্ভাব্যতার কথা শুরুতে বললাম, সেটি কোন সম্ভাব্যতা, তার ধারণা পাই না সহজে। শুধু এটুকু বুঝতে পারি, গণতন্ত্রে যদি শুধু বিত্তশালী ভদ্রলোকদেরই বারবার নানাভাবে দেখা যায়, তাহলে সবার জন্য গণতন্ত্রকে সফল করার যে দায়বদ্ধতা, সেই দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করে রাজনীতি।
দেশে সব পেশার ক্ষেত্রেই নিয়মনীতি ও বিধিবিধান আছে, যোগ্যতার প্রশ্ন আছে; কিন্তু রাজনীতি করতে গেলে কোনো যোগ্যতা, বিধিবিধান ও নিয়মনীতি লাগে না। টাকাওয়ালা হলেই সে বিরাট রাজনীতিবিদ। এমনকি সে এমপি-মন্ত্রীও হয়ে যাচ্ছে হরহামেশাই, যা রাজনীতির জন্য তো বটেই; দেশের জন্যও বিপজ্জনক।
দেশে আজ প্রকৃত রাজনীতিবিদ গড়ে উঠছে না। রাজনীতিবিদ গড়ে না ওঠায় দেশের কথাও কেউ ভাবছে না, জনগণের কথাও কেউ ভাবছে না। সবাই টাকা ইনকামের ধান্ধায় আছে। টাকা হলেই সব হবে- এ ভাবনায় তারা বুদ হয়ে আছে।
দেখা যাচ্ছে- রাজনীতি এখন আর রাজনীবিদদের হাতে নেই। রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা এবং বিদেশ ফেরতসহ অন্যান্য পেশাজীবীর হাতে।
একজন ব্যবসায়ী- সে শুধু তার ব্যবসার কথাই চিন্তা করবে। সে চিন্তা করবে না নিজ দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক কিভাবে স্থাপন করতে হয়। পেশাজীবীরা জানবে না জনগণের আবেগ-অনুভূতির কথা। তারা শুধু নিজ পেশা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, থাকছেও তাই। এসব কারণে আজ দেশে রাজনীবিদ গড়ে উঠছে না। দেশে রাজনীতির সঠিক চর্চাও তাই হচ্ছে না।
ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা যে রাজনীতিতে আসবেন না, তা কিন্তু নয়। তারাও রাজনীতিতে আসতে পারেন। কিন্তু তাদেরকে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে, মাঠের রাজনীতির সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট সময় কাটিয়ে তবেই রাজনীতিতে আসতে হবে। সেই মোতাবেক রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে হবে। একজন নমিনেশন চাইল আর তাকে নমিনেশন দিয়ে দেয়া হল, তা কিন্তু ঠিক নয়।
আসল রাজনীতিবিদ সৃষ্টি না হওয়ায় দেশে তৈরি হচ্ছে ভূইফোঁড় রাজনীতিবিদ; যারা হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি হয়ে উঠছে তাদের টাকা বানানোর মেশিন, যে কারণে দেশে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে। সরকারি সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে, বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে, জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে ইত্যাদি। কারণ তারা রাজনীতির চেয়ে টাকাকেই মুখ্য করে দেখে। টাকার গরমের কাছে বর্তমানে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জ্ঞান, শিক্ষাগত যোগ্যতা, আত্মমর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা, দূরদর্শিতা ইত্যাদি গৌণ।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার, আমলা, ইঞ্জিনিয়াররা রাজনীতিতে প্রথমে এডভাইজার হিসেবে কাজ করে, পরে মূল রাজনীতিতে প্রবেশ করে। তাতে ভারতের রাজনীতির ভিত শক্তিশালী হচ্ছে।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশের রাজনীতির ভিত দুর্বল হচ্ছে। কারণ একটাই- কেউ রাজনীতি শিখে রাজনীতিতে আসছে না। গুটিকয়েকজন এলেও নমিনেশনের সময় বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কাছে তার রাজনৈতিক জ্ঞান গৌণ হয়ে যায়, যখন টাকার ওপর ভরসা করে দলগুলো। এ সুযোগে টাকাওয়ালাদের কাছে রাজনীতি বিক্রি হয়ে যায়। এটা দেখে প্রকৃত রাজনীতিবিদ হতাশায় ডুবে এবং এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর রাজনীতির দিকে ফিরে তাকায় না। মনোযোগী হয় টাকা কামাতে।
কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের সুবাদে নমিনেশন পেয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার পর টাকা বানাতে মত্ত হয়ে পড়ে। কারণ পরবর্তী সময়ে নমিনেশন পেতে হলে, টাকাওয়ালাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গেলে টাকার প্রয়োজন হবে। এ ভাবনায় তারা রাজনীতি বিসর্জন দিয়ে টাকা ইনকামের দিকে ধাবিত হয় এবং বিভিন্ন অন্যায় কাজ ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
যোগ্য ও আদর্শবাদী না হওয়ায় অনেকে রাজনীতিতে এসে বড় ব্যবসায়ী বনে যায়, যা রাজনীতির জন্য বড় ক্ষতির বিষয়। সুস্থ রাজনীতি চর্চার জন্য দরকার সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ, যার অভাব প্রকট। একদিকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই, অন্যদিকে ছাত্ররা দলীয় রাজনীতির শিকার হয়ে নষ্ট করছে সুস্থ রাজনীতির পরিবশে। তাই ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির প্রভাব মুক্ত রাখতে হবে। ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে তাদের দিয়ে দেশের (বায়ান্ন-একাত্তরের মতো) বৃহৎ কোনো অর্জন সম্ভব নয়।ইহাই সত্য।ইহাই বাস্তব।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।