মিরসরাই ট্রাজেডি স্মৃতিচারণ
স্মৃতির দংশনে কাঁদে মন…
স্মৃতির দংশনে কাঁদে মন…
সময় থমকে নেই। বহমান সময়ের সাথে দেখতে দেখতে কেটে গেল নয়টা বছর। নয় কেবল নিছক কোন সংখ্যা না।এবারের মতো (২০২০ সালের) এই নয় হচ্ছে স্বপ্নকুঁড়িদের অকালমৃত্যুর সাক্ষীর নবম তম বাহন। বলছিলাম, ২০১১ সালের ১১ জুলাই রোজ সোমবারের কথা। সেদিন চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার ষ্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু – বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্ণামেন্ট খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে ৪৪ টি স্কুলছাত্রসহ ৪৫ টি তাজা প্রাণ ঝরে যায়।আহা নিয়তি কতোটা নির্মম। কালো থাবায় ঝরে গেল ৪৫ প্রাণ কল্পনা করা যায়? এ যেন এক মৃত্যুর মিছিল। এই শোক ভুলবার নয়। আজো মীরসরাইবাসী এই শোক বইয়ে চলছে। মর্ম বেদনার করুন এই আর্তির নাম “মীরসরাই ট্র্যাজেডি”।
হৃদয়ের মণিকোঠায় কি সব স্মৃতি মনে করা বা ধরে রাখা যায়? কিন্তু হ্যাঁ, সব স্মৃতি মুছে ফেলার কোন অবকাশ নেই।ধরেই যেহেতু রাখতে হবে তবে সহ্য করার মতো শক্তিও মোদের দাও হে বিধাতা। সেদিন মীরসরাই থেকে বড়তাকিয়া হয়ে আবুতোরাব যাওয়ার পথে সৈদালী গ্রাম সংলগ্ন সড়কে আকস্মিক ট্রাক উল্টে এই দূর্ঘটনা ঘটে। এই দূর্ঘটনার ফসল হিসেবে মীরসরাইবাসী গণ মানুষের জানাযা দেখে। তার আগে গণ মানুষের জানাযা, পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ কেউ দেখেননি।ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে সারা বিশ্বে মীরসরাই এর দূর্ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত থেকে দ্রুততর। শোক আরো গভীর হয় নিহতদের স্বজনদের। ফুলে ফেঁপে উঠে ঘৃণার বারুদ। নিহতদের হারানো মায়ের আর্তনাদে আকাশও গুমরে কেঁদে উঠে। দীর্ঘ হয় বোনের বিলাপ কান্না। বাবার চোখে যেন আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন খেলাকরে।
একটি গাড়িইতো সব নষ্টের মূল! চট্টমেট্রো – ড – ১১ – ০৩৩৭ নং গাড়ির অজ্ঞ, অসাবধান, অপারদর্শী চালক মফিজ।স্টিয়ারিং আর হুইল হাতে থাকার বদৌলতে চালক বলতে বাধ্য। না ঠিক চালক নন, চালকের সহকারী। চালকতো অদক্ষ, অপারদর্শী, অসাবধান থাকার কথা না। ইতিহাসের সেই খলনায়ক খ্যাত মফিজের উপর – ই কি সব দোষ বর্তায়? তবে কি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন প্রণেতা, পরিবহন ব্যবস্থার উপর কোন দোষারাপ পড়ে না, বিষয়টি কি এমন? আমাদের আইন প্রণেতারাই বাস্তবিক খলনায়ক।আইন থেকে ও যদি আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইন হিমশিম খায় তবে সেই আইনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? এখনো আমাদের পরিবহন ব্যবস্থার টনক নড়েনি।সড়ক পথে এখনো দেখা মিলে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ, অপারদর্শী ও অপরিপক্ব চালক, প্রতিযোগিতার মনোভাব। এসবের জন্য দায়ী সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, আর সড়ক পরিবহনের এই খেলা বা গড়িমসির জন্য দায়ী আইন প্রয়োগের অভাব। এক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। মফিজদেরকে একতরফা খলনায়ক বলার কি কোন অর্থ হয়? যতোদিন না আইনের শাসন পূর্ণতা পাবে না, কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ হবে না ততোদিন আইন প্রণেতারাও আমাদের চোখে খলনায়ক বলে বিবেচিত। সঠিক আইন প্রয়োগের ফলে এহেন দূর্ঘটনা যেমন হ্রাস হবে ঠিক কেমনি মফিজদের মতো অদক্ষ চালকদের সংখ্যা কমে যাবে এবং সড়ক পথের নিরাপওা নিয়ে এতোটা প্রশ্নবিদ্ধ হবার সুযোগের পরিধি কমে আসবে।
উল্লেখ্য ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাতে ১৩ নং মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের সম্মানীত চেয়ারম্যান মাষ্টার কবির আহম্মেদ নিজামী বাদি হয়ে মীরসরাই থানায় চালক মফিজের বিরুদ্ধে একটি মামলা (নং – ৫) দায়ের করেন। মামলার ১০ দিন পর অর্থ্যাৎ ২১ শে জুলাই সকাল সাড়ে ৮ :৩০ মিনিট নাগাদ বরিশালের কাউনিয়া থানা পুলিশের একটি দল অভিযান চালিয়ে বাতনা গ্রামের ফরাদের ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় চালক মফিজকে আটক করা হয়। স্বপ্নকুঁড়ি বলুন, ফুল বলুন, আর শিক্ষার্থী বলুন তাদের চলে যাবার নির্মম এই গল্প কি আর লিখে শেষ করা যায়?
“আজো কানে ভাসে সে কথাগুলো কে জানে হবে যে শেষ কথা / নিয়তির ডাকে দিলে যে সাড়া ফেলে গেলে শুধু নিরবতা”। কেউ কি জানতো সাইফুলের বলা কথার মতো তার দল জিতবে? সত্যিইতো সাইফুলের দল জিতেছিল কিন্তু কালের গর্ভে হারিয়ে গেল সাইফুল। আমাদের স্মৃতিগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।প্রতিবছর ১১ জুলাই এলে স্বপকুঁড়িরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। আকাশকে রাশভারি করে ১১ জুলাই আসে যায় অথচ সাইফুলদের আসার সুযোগ নেই। সাইফুল, টিটু, তারেকদের জীবন সেই ১১ জুলাই’র ০১ মিনিট নিরবতা পালনের মধ্যেই যেন নিহিত। শোকাহত ৪৫ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে আজকের মতো শেষ করছি। ওপারে ভালো থাকুক আমাদের ভাইয়েরা।
লেখক : রিয়াদ হোসেন (রাজু)
কবি, শিক্ষার্থী ও প্যালিন্ড্রোমিস্ট।
সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ