বঙ্গমাতাকে নিয়ে জাতির পিতার স্মৃতিচারণঃমোহাম্মদ হাসান
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনে যার অসামান্য অবদান। যার সহযোগিতায় সার্থক হয়ে উঠেছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন। সে কথা স্বীকারও করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন।
কারাগারের রোজনামচায় প্রসঙ্গক্রমে অনেকবার এসেছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি নিজের সন্তান, স্ত্রী, পরিবার-পরিজন, বাবা-মা সবকিছু ফেলে দেশের জন্য, দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠকে বেছে নিয়েছিলেন। পরিবারের জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ দেখি তার লেখায় : ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়!…
দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’…
‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, ‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে। ‘রাসেল’ আব্বা আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’
কারাগারের রোজনামচায় নিজের পরিবারের অর্থকষ্ট ফুটে উঠেছে তার লেখায়। মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আত্মত্যাগের কথা বলতেও বঙ্গবন্ধু ভোলেননি :‘সংসারের কথা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আব্বা আম্মা’র শরীরের অবস্থা আলোচনা করতে করতে চলে যায়। কোম্পানি আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি- চারমাস হয়ে গেল আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, ‘জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাঙ্কেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না’ ‘যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব’, রেণু বলল। সরকার যদি ব্যবসা করতে না দেয় তবে বাড়িতে যে সম্পত্তি আমি পেয়েছি আব্বার, মায়ের ও রেণুর তাতে আমার সংসার ভালভাবে চলে যাবে। রেণু বলল, ‘চিন্তা তোমার করতে হবে না।’ সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি’।’
বন্দিরা সপ্তাহে একটি চিঠি আর ১৫ দিনে একবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারত। কিন্তু সেখানেও বাধা-নিষেধ ছিল। গোয়েন্দা দফতরের কর্মচারীদের পড়ার পর চিঠি হাতে পাওয়া যেত, সাক্ষাতের সময় গোয়েন্দা ও জেলের কর্মচারীরা উপস্থিত থাকত। বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে লিখেছেন : ‘নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছ হয়, কিন্তু উপায় কী? আমরা তো পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ হই নাই। তারা তো চুমুটাকে দোষণীয় মনে করে না। স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে কিন্তু বলার উপায় নাই।’
বঙ্গবন্ধু তার ‘কারাগারের রোজনামচা’বইয়ের অগণিত স্থানে তার সহধর্মিণীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে বেগম মুজিবের ধৈর্য, ত্যাগ ও অবদানের বিবরণ দিয়েছেন। প্রায় ৪০ বছরের দাম্পত্য জীবনে বেগম মুজিব ভালোবেসে তার স্বামীর সংগ্রামমুখর, ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে সঙ্গী ছিলেন। তবে বেগম মুজিব সবসময় তার স্বামীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন।
বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী যেমন তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন আবার বঙ্গবন্ধুও বেগম মুজিবের ওপর কোনো অংশে কম নির্ভরশীল ছিলেন না। শুধু পারিবারিক জীবন নয়; বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে ঝুঁকি ও সংকটকালীন মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেগম মুজিব নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছেন। বেগম মুজিবের রাজনেতিক পরামর্শ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছেন এমন দৃষ্টান্ত কম নয়।
বঙ্গবন্ধু প্রায়ই মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হতেন। তাই ব্যথা হলেই ব্যথানাশক স্যারিডন সেবন করতেন। বেশি ব্যথা করলে ২-৩টা একসঙ্গে খেয়ে নিতেন। বেগম মুজিব ব্যথানাশক ওষুধ খেতে নিষেধ করতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু খুব একটা আমল দিতেন না। কারাগারে তীব্র মাথা ব্যথ্যায় আক্রান্ত হওয়ার পর তার প্রিয় সহধর্মিণীর কথা মনে পড়েছে। লিখেছেন : ‘রেণু স্যারিডন খেতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। আমি বলতাম আমার হার্ট নাই। অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। বাইরে তার কথা শুনি নাই, কিন্তু জেলের ভিতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না।’
বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নানা সময়ে আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছে। ভরসা ছিলো পিতা শেখ লুৎফর রহমান আর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা। পারিবারিক ব্যয় হ্রাসের জন্য বেগম মুজিব বললেন : ‘যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব।’ বঙ্গবন্ধু আশ্বাস দিতে গিয়ে বললেন : ‘পারিবারিক সম্পদের আয় থেকে সংসার চলে যাবে।’ বেগম মুজিব সুস্পষ্টভাবে বললেন : ‘চিন্তা তোমার করতে হবে না।’
বাস্তবে আন্দোলন, সংগ্রাম, জনগণ, দেশ ছাড়া তার ভাবনার জগতে আর কিছু ছিল না। এমন যোগ্য সহধর্মিণী পেয়েছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু অখণ্ড মনোযোগ দিতে পেরেছিলেন দেশ ও জাতির জন্য।
তথ্যসূত্র: কারাগারের রোজনামচা- শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি ও কলাম।