আওয়ামী লীগের ঘরে বাইরে হাইব্রিড: মোহাম্মদ হাসান
ওয়ান-ইলেভেনসহ দুঃসময়ে যারা আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করেছেন, তারাই এখন সুবিধা লুটতে আওয়ামী লীগে যোগদান করছেন। নিন্দুকেরা এদের নাম দিয়েছেন “হাইব্রিড”। ঘরে-বাইরে এখন হাইব্রিডের ছড়াছড়ি। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীরা এখন জেলা-উপজেলায় চালকের আসনেও বসেছেন। “অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে নয়” দলের হাইকমান্ডের এমন নির্দেশনা থাকলেও তোয়াক্কা করেননি দ্বায়িত্বশীল নেতারা। এই একযুগ সময়ে কমপক্ষে অর্ধলক্ষাধিক অনুপ্রবেশ ঘটেছে আওয়ামী লীগে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়ের পর থেকেই দলের বিভিন্ন স্তরে শুরু হয় ব্যক্তি কেন্দ্রিক দলভারি করার প্রবণতা এক কথায় বলয় সৃষ্টি। কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপিরা নিজ বলয় ভারি করতে “ফুলের তোড়ায়” বরণ করে নেন বিএনপি ও জামায়াত-শিবির বা ভিন্ন কোন দলের নেতাদের। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যাসহ নাশকতা ও অবৈধ অস্ত্রের একাধিক মামলা। দল বদল করে আওয়ামী লীগে এসে রাতারাতি পুনর্বাসিত হয়েছেন তারা।
সবাই এখন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সাজতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। প্রায়ই সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে এ প্রবনতা দৃশ্যমান। বিশেষ করে বর্তমান ও সাবেক আমলা, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী কিংবা প্রকৌশলী— সবাই এখন নিজেদের গায়ে আওয়ামী লীগের “তকমা” লাগাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। পিছিয়ে নেই সাংস্কৃতিক কর্মী কিংবা সাংবাদিকরাও। প্রশাসনের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও নিজেদের এখন “বিশুদ্ধ আওয়ামী লীগার” হিসেবে জাহির করতে শুরু করেছেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ রাজনীতির এমন সংস্কৃতি বা এ প্রবণতা অতীতে কখনই দেখা যায়নি। এটা আওয়ামী লীগের আদর্শিক রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।
দল আবারও কখনো দুঃসময়ে পড়লে এর চরম মূল্য দিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। এখন আওয়ামী লীগ দীর্ঘ বছর ক্ষমতায় থাকায় সুবিধায় আছে। তাই তৃণমূল থেকে প্রশাসনের সর্বত্র আওয়ামী লীগ হওয়ার অতি উৎসাহীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দল বেকায়দায় পড়লে এসব আওয়ামী লীগারকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখনই সময়, নব্য আওয়ামী লীগারদের লাগাম টেনে ধরার।
বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, “আমাদের শিক্ষিতসমাজের সুবিধাবাদী শ্রেণি এখন আওয়ামী লীগের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন না। প্রকাশ্যেই তারা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। এর আগে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে ছিল। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনে যখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হন, তখনো এসব পেশাজীবী শ্রেণিকে সভা-সমাবেশ কিংবা মানববন্ধন করতে দেখা যায়নি। কোনো কিছুরই অতিমাত্রা ভালো নয়। এখন তারা রাস্তাঘাট দখল করে নিজেদের আওয়ামী লীগ দাবি করে শোডাউন দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে”।
নীতি আদর্শের এই প্রবণতা শুধু আদর্শের অভাবই নয়, এটা সততারও অভাব। বাংলাদেশের রাজনীতি এতটা নষ্ট হতো না যদি এই জাতীয় অসাধুতা ও সুবিধাবাদ না থাকতো। এটা তারা করতে পারছে এ জন্য যে, হয়তো আওয়ামী লীগও চায় দেশের মানুষ তাদের সমর্থন করুক আর না করুক— চাটুকারীতা করুক। আমলাদের একটি বড় অংশ ছাত্রজীবনে এক দিনও ছাত্রলীগের রাজনীতি না করলেও তারা এখন বিগত দিনের মহান ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন এমন জাহিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব, সচিব, উপসচিব, যুগ্মসচিবসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার টেবিলে বা সহজেই মানুষের দৃষ্টি যায় এমন সুবিধাজনক স্থানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রচিত বিভিন্ন বইপত্র এখন শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া এমপি-মন্ত্রীদের কাছে তাদের পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারাও ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে গিয়ে ত্যাগ স্বীকার করেছেন বা বিগত সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে তাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে এমন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছেন। যে কোনো মূল্যে তারা নিজেদের আওয়ামী লীগপন্থি আমলা প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। শুধু সচিবালয়ই নয়, বিভাগীয়, জেলা-উপজেলার দফতরেও একই চিত্র।
টিআর-কাবিখা-কাবিটা— কোথায় কত দেওয়া হবে, কোন চেয়ারম্যানকে কত দেওয়া হবে; এসবের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছেন কিছু কর্মকর্তা বা স্থানীয় এমপির পছন্দের বা সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ । স্থানীয় এমপি বা মন্ত্রীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে সরকারি কর্মকর্তাই এখন বড় আওয়ামী লীগার ওই এলাকায়। পিছিয়ে নেই পুলিশও। বিশেষ করে রাজধানীতে দলবাজির বাড়াবাড়ি বেশি বলে দৃশ্যমান।
বিএনপির একটি বড় অংশ নির্বিঘ্নে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে নিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে আঁতাত করে চলেছেন। এমনকি তারা কেউ কেউ আওয়ামী লীগ পরিবারের সঙ্গে কুটুম্বিতা করে নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলছেন। এ চিত্র সারা দেশে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত। কোনো কোনো এলাকায় কেউ কেউ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, স্থানীয় এমপিদের হাত ধরে বিএনপি থেকে নৌকায় উঠে রাতারাতি আওয়ামী লীগ নেতা বনে যাচ্ছেন। দলে যোগদান করেই তারা নিজ এলাকায় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে টেন্ডার, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এমনকি ২০১৩ সালের আগে জামায়াত-বিএনপি অধ্যুষিত যেসব এলাকায় পুলিশ পাহারায় এমপি-মন্ত্রীদের যেতে দেখা গেছে বা কেউ নিজ এলাকাতেই যাননি, এখন সেসব এলাকা শুধুই আওয়ামী লীগ।
কমিউনিস্ট, বিএনপি-জামায়াত নেতারা এখন খোলস পাল্টিয়ে হয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ নেতা নীতিনির্ধারক। জামায়াতের একটি অংশ নিজেদের মামলা-মোকদ্দমা থেকে বাঁচাতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে চলছেন। জামায়াতের শিক্ষা, হাসপাতাল, বীমা, ব্যবসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতাদের চেয়ারম্যান, এমডি বা পরিচালক পদে রেখে জামায়াত নেতারা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করে চলছেন। সারা দেশে জামায়াত-শিবির নেতাদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চললেও আঁতাতকারী ওই জামায়াত-শিবিরের নেতারা এখনো বীরদর্পে ঘুরে বেড়ান।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বামপন্থিরাও এখন সরকারের অংশ। বাম দলের এমপি-মন্ত্রী এমনকি নেতারাও এখন বড় আওয়ামী লীগারের ভূমিকায়। সংসদ বা বিভিন্ন সভায় বক্তৃতার শুরুতেই সরকার বন্দনায় শুরু করে জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু দিয়ে শেষ করেন। বাম দলের নেতারাও এখন আওয়ামী লীগারদের চেয়ে বড় লীগার হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। জোটের বাইরে থাকা বাম দলগুলোর মধ্যে দু-একটি ছাড়া প্রায় অধিকাংশই এখন আওয়ামী লীগ হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা নীতিভ্রষ্ট হয়ে কীভাবে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা যায়, সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ শিক্ষকরা এখন রাজনীতির সঙ্গে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়েছেন। তারা এখন সবাই আওয়ামী লীগার। গেলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও যেসব শিক্ষক বিএনপি বা অন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বা মৌন সমর্থক ছিলেন তারাও এখন আওয়ামী লীগার।
সারাদেশে অতি উৎসাহী বা নব্য আওয়ামী লীগারের আস্ফাালনে দীর্ঘদিনের ত্যাগী আওয়ামী লীগাররা এখন কোণঠাসা। আওয়ামী লীগে “অনুপ্রবেশের” বিষয়টি এখন দেশময় আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা। রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের উত্তরসূরিরা এখন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শাখার পদ-পদবি কিনেছেন তারা। হয়ে উঠেছেন বড়ো নেতাদের ঘনিষ্ঠ। একই সঙ্গে এসব পদবি ব্যবহার করে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরিতে নিয়োগসহ ব্যবসা, বাণিজ্য, ঠিকাদারিসহ সবকিছু নিজেদের আয়ত্বে নিয়েছেন। এমনকি মাদক ব্যবসায় জড়িত তাদেরই সিন্ডিকেট।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলে এই অনুপ্রবেশের ঘটনা হঠাৎ করে ঘটেনি; শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে, ঢালাওভাবে হয়েছে ২০১৪ সালের পর এবং সব অনুপ্রবেশই ঘটেছে দলের কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের হাত ধরেই। দলে বিরোধী মতাদর্শীদের এ ধরনের ঢালাও অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভাপতি দেশরত্ন শেখ হাসিনা কয়েকবারই দলীয় নেতাদের সতর্ক করেছেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ১১ বছরে ৫৫ হাজার বিরোধী মতাদর্শী আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে অনুপ্রবেশ করেছেন। বিষয়টি দলের জন্য অশনিসংকেত—সাংগঠনিক ও গোয়েন্দা রিপোর্টে এমন তথ্য উঠে আসায় বিতর্কিত অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু বা শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে, হচ্ছে, চলছে বলা হলেও বাস্তবতায় কিছুই হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আর দলকে ভালোবেসে যাঁরা আওয়ামী লীগ করেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, সেসব ত্যাগী নেতারা এখন আছেন দুর্দিনে। তাঁরা এখন কোণঠাসা, দলে পদ-পদবিও পাচ্ছেন না। চরম হতাশা নিয়ে নীরবে দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই। আর যারা জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, ২০০৫/৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, যারা ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় আগুন সন্ত্রাস আর তাণ্ডব চালিয়েছিল সেই তারাই সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের দলীয় বড় বড় পদে আসীন এখন তারাই। ক্ষমতা আর নিজের আখের গোছাতেই সেসব জামায়াত-বিএনপির নেতা ভোল পাল্টে দল পাল্টে এখন আওয়ামী লীগার সেজেছে, তারাই এখন নেতাদের কাছের লোক। যারাই প্রতিবাদ করছে তারা নির্যাতন আর জুলুমের শিকার হচ্ছেন। শুধু নির্যাতনই নয়, দলের ত্যাগী নেতাদের উপজেলা কিংবা জেলা কমিটি থেকেও বিতাড়িত করে জামায়াত-বিএনপির লোকদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নেতার বাড়ির কাজের লোকরাও এখন বিভিন্ন কমিটির বড় বড় পদ পাচ্ছে।
আর এভাবে চলতে থাকলে আওয়ামী লীগের দুঃসময় আত্যাসন্ন। আর তখন আগামীর সম্ভাব্য আওয়ামী লীগের মাঝিগণ মাঝ দারিয়া হতে তীরে ভিরতে গিয়ে অশুভ বৈরী হাওয়া মোকাবেলা করতে করতে হয়তো যুগ কেটে যাবে।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।