প্রাণের ৭১

জাতিকে মেধাশুন্য করে দেয়ার ঘৃণিত পরিকল্পনার অংশ বুদ্ধিজীবী হত্যা: মোহাম্মদ হাসান

জাতিকে মেধাশুন্য করে দেয়ার ঘৃণিত পরিকল্পনার অংশ ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা! এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এক আলোচনায় বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবী ছাড়া যেমন বড় ধরনের কোন বিপ্লব সংঘটিত হয় নি, তেমনি তাদের ছাড়া কোন বিপ্লববিরোধী আন্দোলনও সংঘটিত হয় নি। এক কথায়, তারাই হচ্ছেন ‘বিপ্লব’ এর প্রাণ। অন্যভাবে বলা যায়, শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকার জন্যে যেমন একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী প্রয়োজন, তেমনি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যেও আরেক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদেরকে শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়। এ কারণেই দেখা যায় যে, গত শতাব্দীর শুরুতেই আর্মেনিয়ায় গণহত্যা শুরু হয়েছিল ২৫০ জন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার ও হত্যার মাধ্যমে। হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীও পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করেছিল। এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মোটেই নতুন কিছু নয়, বরং প্রকৃতিগত দিক হতে পূর্বের গণহত্যাগুলোর সাথে এটা সাদৃশ্যপূর্ণই বটে।

‘৭১ এর ২৫ শে মার্চের রাত থেকেই শুরু হয় মূলত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ এবং ১৪ ডিসেম্বর সেটার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি, তবে বাংলাপিডিয়ার সূত্রমতে, এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী,এবং অন্যান্য ২ জন।

১৯৪৭ থেকে ৭১ – এ সময়ের মধ্যে বাঙালিরা বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের গণ্ডি থেকে বের হয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’ প্রবেশ করে। এবং, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের দ্বারা এই জাতীয়তাবোধের যে উন্মেষ ঘটেছিল, পরবর্তীতে সেটার অগ্রগতিতে মূল অবদান ছিল তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদেরই। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আমলে প্রথমে আঘাত আসে সংবাদপত্রের ওপর, শাসকচক্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিকরা দমন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন। সামরিক শাসনবিরোধী সাংবাদিকদের বিদেশ গমনেও বাধা দেয়া হয়। তবু ‘ইত্তেফাক’ কিংবা ‘সংবাদ’ ক্ষমতাসীনদের কাছে খুব একটা নতি স্বীকার করেনি। তৎকালীন সামরিক শাসক চক্র বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর সর্বাধিক নোংরা আক্রমণ চালায়; পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান – এই দুই অঞ্চলের সংহতি বৃদ্ধির অজুহাতে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হয়।

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তখন এই ভাষা সংস্কারের তীব্র প্রতিবাদ জানান। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যের ওপর আসে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ; তাঁকে চিহ্নিত করা হয় হিন্দু কবি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে। এই ‘হিন্দুয়ানী’র অভিযোগ তুলে নজরুলের কবিতা থেকেও ‘হিন্দুয়ানী’ শব্দ বাদ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। ‘সজীব করিব মহাশশ্মান’ এর স্থলে লেখা হলো “সজীব করিব গোরস্থান”।

ছাত্রীদের কপালে টিপ দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ জারী করা হয়, কেউ টিপ দিয়ে গেলে তাকে কর্তৃপক্ষের হাতে হেনস্থা হতে হত। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে সামরিক সরকার আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করে যে, রবীন্দ্রনাথ আসলে পাকিস্তান আদর্শ বিরোধী। প্রতিবাদস্বরূপ এগিয়ে আসেন বুদ্ধিজীবীরা। বিভিন্ন জায়গায় রবীন্দ্রজয়ন্তী কমিটি গঠন করে অনুষ্ঠান আয়োজন করা শুরু হয়। মেয়েরা কপালে টিপ দেয়া শুরু করেন। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুন হকের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ছায়ানট’। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বুদ্ধিজীবী মহলের এমন সাহসী প্রতিবাদ জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশে সাহায্য করেছিল তুমুল ভাবে।

একই সুরে গবেষক বদরুদ্দীন উমর মন্তব্য করেছিলেন, ‘পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের গোঁড়া পর্যন্ত এদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুবিধাবাদী লোক থাকলেও তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অভাব ছিল না। সেটা না হলে সেই পর্যায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অগ্রসর হতো না এবং স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধতো না’।

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতির জন্য কলঙ্কময় দিন। যতদিন পৃথিবী থাকবে এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছিল এবং পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পারলো মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখনই এদেশের পাকিস্তানি দোসর, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পারলো মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত তখনই বাঙালি জাতি যাতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেই চিন্তা ধারায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়।

কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র বলেন তাদের কাছে খবর এসেছে যে বুদ্ধিজীবী হত্যায় একজন শীর্ষ পাক জেনারেল সহ ১০ সেনা কর্মকর্তা জড়িত। এ পর্যন্ত ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার খবর তাদের কাছে পৌঁছেছে। আরও হত্যার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কতক অফিসারের বুদ্ধিমত্তায় তারা রক্ষা পেয়েছে। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকার সময় বুদ্ধিজীবীদের সভা করার নামে ডেকে নেয়া হত কিন্তু সে সকল সভায় তেমন কেউ অংশ নেয়নি বিধায় অনেকে রক্ষা পেয়েছে। জামাতে ইসলামীর কিলিং স্কোয়াড আল বদর, আল শামস এর মাধ্যমে জেনারেল রাও ফরমান আলী এ সকল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। ব্রিটিশ এমপি জন স্টোন হাউজ বলেছেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ইহুদী বুদ্ধিজীবী হত্যার পর বাংলাদেশে এ ধরনের ২য় ঘটনা ঘটল।

১৪ তারিখের গভর্নর হাউজের সভায় অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল। চট্টগ্রামেও অনুরুপ এক সভা ডাকা হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় সভা করার নামে অনেককে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী ওই সকল রাজাকারদের বাঙালি জাতি কোনোদিন ক্ষমা করবে না বা করতে পারে না।

লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
তথ্যসূত্রঃ সংগ্রামের নোটবুক ও সংগৃহীত।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*