প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে! বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলা: মোহাম্মদ হাসান
আমাদের জীবনে অনেক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেই সম্পর্কগুলো মাঝে মধ্যে পরিবারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরিবারের সম্পর্ক সমাজে স্বীকৃত, বাস্তবসম্মত এবং অটুট। কখনও কখনও সম্পর্কের টানাপড়েন এই অটুট বন্ধনেও শিথিলতা নিয়ে আসে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কারও কারও জীবনে আবার সম্পর্ক ঠিক আগের জায়গায় ফিরে যায়, কারওটা আবার অপ্রত্যাশিতভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। কারও জীবনে সম্পর্ক আবার নতুন মাত্রা নিয়ে আসে। জীবন বৈচিত্র্যময় আর এই বৈচিত্র্যময় জীবনে সম্পর্কের বিচিত্রতাও আমাদের কম ভাবিত করে না। এই ভাবনার দোলাচলে বসে কলকাঠি নাড়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলা। পরিবারের বাইরের অচেনা যে কেউ বিশ্বস্ততা দেখিয়ে আপনার কাছে আপন হয়ে উঠতে পারে। আবার পরিবারের একান্ত প্রিয় মানুষটিও হয়তো অবিশ্বাসের চোখ রাঙানি দিয়ে আপনাকে দূরে ঠেলে দিতে পারে।
নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমে ফজলুল হক খান এর “যে শোকে বাংলার ইতিহাস কাঁদে” শিরোনামে লেখায় ছিলো, সংঘাতময় এ পৃথিবীতে, আবহমানকাল ধরে চলে আসছে, ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত, সুন্দর-অসুন্দরের সংঘাত, ঘৃণা-ভালবাসা, শান্তি-অশান্তি, অসুর আর মানবতার সংঘাত। নিরবচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় চলে আসা ইতিহাসের আমোঘ ধারায়, ন্যায় এবং সত্যকে বার বার মোকাবেলা করতে হয়েছে অন্যায়-অসত্যকে, ভেতর বাহিরের কুটিল ষড়ষন্ত্রকে। এ সংঘাতের মোকাবেলায় কত মহাপুরুষের রক্তে ভিজে গেছে পৃথিবীর বুক, সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহ সঙ্কট, বিপন্ন হয়েছে মানবতা, তার ইয়ত্তা নেই।
আততায়ীর হাতে মহাপুরুষের মৃত্যুবরণ যেমন সংঘাতের এক অনিবার্য ঘটনা, তেমনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। ইসলামের মহান চার খলিফার তিনজনই যেমন শহীদ হয়েছেন আততায়ীর হাতে, তেমনি এ গুপ্ত হত্যার তালিকায় ছিলেন ক্রুসেড বিজয়ী বীর সেনানী সালাহউদ্দিন আয়ুবী ও ইমাম ইবনে তায় মিয়ার ন্যায় মনীষীও। এজিদের নৃশংসতায় কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনার বেদনাদায়ক চিত্র আজও ইতিহাসের পাতায় অঙ্কিত। শহীদ হয়েছেন ইমাম হাসান, ইমাম হোসেনসহ মহানবী (স) এর অসংখ্য অনুসারী। কারবালা প্রান্তরে এজিদের নৃশংসতা ও বর্বরতার শিকার নারী-পুরুষের আর্তনাদ, বিষাদের ছায়া আর শহীদের বিন্দু বিন্দু রক্তে রচিত হয়েছে বিষাদসিন্ধু।
বিষপানে হত্যা করা হয়েছে সক্রেটিসকে, ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে যিশুখ্রিস্টকে। এ সংঘাতের কারণেই জীবন প্রদীপ নিভে গেছে রোমের সিজার, জায়ারের লুবাম্বা, গ্রানাডার মরিস বিশপ, চিলির আলেন্দেসহ অসংখ্য মহাপুরুষের। আততায়ীর বুলেটের নির্মম আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে এ উপমহাদেশের মহাত্মা গান্ধী, লিয়াকত আলী খান, ইন্দিরা গান্ধীসহ বিশ্বের জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক আব্রাহাম লিংকন, জন, এফ, কেনেডির মতো মহান নেতাকে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় টিপু সুলতানের বীরত্ব ও দেশপ্রেম ব্যর্থ হয়েছে, তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে শুধু এদেশের আলো, বাতাস, অন্নে পুষ্ট কতিপয় বিশ্বাসঘাতক মোনাফেকদের ষড়যন্ত্রের কারণে।
মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় যেমন বাংলার শেষ সূর্য অস্তমিত হয়েছে পলাশী প্রান্তরে, তেমনি জীবন দিতে হয়েছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মীরনের আদেশে মোহাম্মদী বেগের হাতে। ন্যায়-অন্যায়ের এ সংঘাতের কারণেই মনসুর হেযাজের মতো সত্যবাদী ধার্মিককেও কতল করা হয়েছে। মনসুর হেযাজ অন্যায়, অসত্যের সঙ্গে কখনও আপোস করেননি, সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তাই তার দ্বিখ-িত মাথা তখনও বলেছে ‘আনাল হক’ অর্থাৎ আমিই সত্য। এসব হত্যাকা- যেমন নিছক হত্যাকা- নয়, সংঘাতের অশুভ পরিণতি তেমনি জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ককে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা দখলও কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আবহমানকাল ধরে চলে আসা ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত এবং ছক বাঁধা এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা ইতিহাস পড়ি কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। ’৭৫ এর প্রধান মীর জাফর খন্দকার মোশতাক হতে চেয়েছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু সে ক্ষমতা স্থায়ী হয়নি। মাত্র ৮১ দিনের মাথায় মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে চুরির দায়ে জেলে যায়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আর কোনদিন জনসম্মুখে বেরোয়নি। আপন বাসভবনে বন্দী অবস্থায় নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা এবং বিবেকের দংশনে মানুষের আদালতকে ফাঁকি দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। বিচার শুরু হয় বিধাতার আদালতে, নিজের সন্তানও মীর জাফরের সন্তানের পরিচয়ে এদেশে বাস করতে চায় না।