“ঘরের চাবি না, মনে হয় ঈদের চাঁন হাতে পাইছি”: মোহাম্মদ হাসান
মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধু কন্যার নতুন পাকা ঘর পেয়ে অনেক অসহায় , বিধবা, ঘরহীন, প্রতিবন্ধীদের ভাষ্যছিলো “ঘরের চাবি না, মনে হয় ঈদের চাঁন হাতে পাইছি”
মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোকে জমি ও গৃহ প্রদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৩ জানুয়ারি শনিবার শনিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৪৯২টি উপজেলার ৬৯ হাজার ৯০৪ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পাকা ঘরসহ বাড়ি হস্তান্তর করেন তিনি।
অসহায় , বিধবা, ঘরহীন, প্রতিবন্ধীদের দেখেই ঘর দেওয়া হয়েছে। ঘরহীন মানুষের ঘর পাওয়ার মাধ্যমে তাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন আসবে। ঘর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে অনেকে। এ যেন খুশির কান্না। সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। অনেকের ভাষ্য এমন : “ঘরের চাবি না, মনে হয় ঈদের চাঁন হাতে পাইছি”।
মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে জমির দলিলসহ পাকা বাড়ি পেয়েছেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হক জজ মিয়া।
দুইবারের সংসদ সদস্য হয়েও জীবনের শেষ বেলায় এসে একেবারেই নিঃস্ব এই মানুষটি উপহারের ঘর পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন। ঘর পাওয়ার পর তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘরে শুয়ে এবার শান্তিতে মরতে পারব।
দেশের ৬৯ হাজারের বেশি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের সঙ্গে জজ মিয়া মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে আনন্দে ভাসছেন। তাই তো পাকা ঘর এবং জমির দলিল বুঝে পেয়ে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত দুইবারের সাবেক এই সংসদ সদস্য কৃতজ্ঞতা জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।
কারণ দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করতে পারেননি জজ মিয়া। সন্তানেরাও পারেননি সেই স্বপ্ন পূরণ করতে। কিছুদিন আগে তার দুর্দশার কথা তুলে ধরে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। অবশেষে জীবন সায়াহ্নে এসে বসবাসের জন্য নিজের ঘর পেলেন জজ মিয়া।
অন্যের ঘরে নিজের জন্ম। সন্তানের জন্মও অন্যের ঘরে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর নিজের নামে তিনিই কিনা পেলেন জমির দলিল ও ঘরের কাগজ! তাই উচ্ছ্বাস যেন কমছে না ইটভাটা শ্রমিক মোকসেদুলের।
মোকসেদুলের বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুরে। নতুন পাওয়া ঘর ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে বললেন, আধা পাকা ঘরটি তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। থাকার কক্ষের সঙ্গে রান্নাঘর। পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও ভালো। বিদ্যুৎ আছে। পানি আছে। পরিবার নিয়ে এখন খুব ভালোভাবে থাকতে পারবেন।
ছয়ডা পোলাপান লইয়া ছাপড়ার নিচে থাকতাম। মাঝে ছন আর কলাপাতা দিয়ে ঘর বানইতো আমার পোলারা। খুব কষ্ট হইতো ঘরে থাকতে। আশপাশে ঠাডা (বজ্রপাত) পড়লে পরাণে পানি থাকতো না। আইজ শেখের বেটি আমাগো দিকে চাইছে, আল্লাহ তারে বাঁচাই রাখুক’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উপহার পাকা ঘর পেয়ে আবেগাপ্লুতো হয়ে এসব কথা বলেন শিবচর উপজেলার নলগোড়া এলাকার মৃত কালাই খাঁর স্ত্রী আলেকজান (৬৫)। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর আওতায় আকেজানকে পাক ঘর দেওয়া হয়েছে।
জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মনিরুল ইসলাম (৪৮)। এক চোখে মাত্র কয়েক হাত দূর পর্যন্ত আবছা ছায়ার মতো দেখতে পান। অসচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়ায় শৈশব থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মনিরুল। পরিবারের সদস্যদের দু’মুঠো খাবার জোগাড়ে যখন যে কাজ পেয়েছেন, করেছেন। মনিরুল ইসলামের স্ত্রী জাহানারা খানমও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।
এই দম্পতির দুই ছেলে। বড় ছেলে জাহিদুল ইসলামও জন্মান্ধ। সংসারে নিত্যঅভাব, তারপরও বহু কষ্টে সংসারের হালধরে রেখেছেন।
মনিরুল ইসলাম তার পরিবার নিয়ে থাকতেন বরিশালের সদর উপজেলার উত্তর লামছড়ি গ্রামের পৈত্রিক ভিটায়। জরাজীর্ণ টিনের দোচালা একটি ঘরে ছিল তাদের বসবাস। সামান্য বৃষ্টি হলে চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ত। সন্তানদের নিয়ে সারারাত জেগে থাকতেন। টাকার অভাবে ঘর মেরামত করার সামর্থ্য ছিল না।
মনিরুল ইসলাম স্বপ্ন দেখতেন লেখাপড়া করে দুই ছেলে ভালো চাকরি করবে। তাকে কাজ করতে হবে না। সংসারে থাকবে না অভাব- অনটন। আর জরাজীর্ণ ঘরটির জায়গায় নির্মাণ হবে পাকা দালান। কিন্তু হঠাৎ করে সব এলোমেলো হয়ে গেল। গতবছর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মনিরুল ইসলামের বসতভিটা ও ৩০ শতাংশ ফসলি জমি কীর্তনখোলা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকে অন্ধকার জীবনে বাড়তে থাকে আঁধারের গাঢ়তা।
পরিবারের সদস্যদের দু’মুঠো খাবার জোগাড়ে যেখানে তাকে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে জমি কিনে ঘর বানানো তার কাছে অসাধ্য ব্যাপার। বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পর তার স্ত্রী দুই ছেলেকে নিয়ে আশ্রয় নেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। আত্মীয়ের বাড়িতে বেশিদিন থাকার উপায় নেই। কারণ আত্মীয়-স্বজনদের অবস্থা অনেকটাই তাদের মতো। তাদের সংসারেও অভাব-অনটন। তাই কিছুদিন পরপর এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
মনিরুল ইসলামের আশ্রয় হয় জাতীয় অন্ধ সংস্থার বরিশাল জেলা শাখার কার্যালয়ে। রাতে কাজ শেষ করে সবাই চলে গেলে ওই অফিসের মেঝেতে ঘুমানোর সুযোগ হয় তার।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমান
এভাবে বসবাসই যখন তার পরিবারের নিয়তি ভাবা শুরু করলেন, তখন উপজেলা প্রশাসন সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল। মুজিববর্ষে বাংলাদেশের একজনও মানুষ গৃহহীন থাকবে না, প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে জমিসহ টিনের ছাউনি দেয়া পাকা ঘর পেয়েছেন তিনি। ঘর পেয়ে খুশির জোয়ারে ভাসছে মনিরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা।
ধরলা নদীর ভাঙনে জামিলা বেগমের ভিটা গেছে, ঘরও গেছে। জমি কিনে বাড়ি করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না। ৫ বছর ধরে থাকছেন অন্যের আশ্রয়ে। সেই জামিলার দুঃখ ঘুচতে যাচ্ছে আজ। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তিনি একটি আধা পাকা ঘর পেলেন।
জামিলা বেগমের পাশের ঘরে ছিলেন দেলো বেগম। তাঁর বয়স ৮০ বছরের বেশি। তাঁর জীবনের গল্পটা ভিন্ন। তাঁর স্বামীর জায়গা–জমি ছিল না। স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি ছিলেন বাবার দেওয়া জমিতে। কিন্তু সেই জমি প্রতারণা করে লিখে নেন এক প্রতিবেশী।
৪৫ বছর আগের সেই ঘটনা আজও দেলো বেগমকে পীড়া দেয়। বললেন, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ভুলতে পারি না। তিনি বলেন, ‘শ্যাষ বয়সে আইসা জমি ও ঘর পাব, কোনো দিন ভাবতে পারি নাই। শেখ হাসিনা ঘর দিছে, আল্লায় তাঁক শান্তি দিক।’
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।