শুরু হলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি: মোহাম্মদ হাসান
বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনন্য গৌরবময় ভাষার মাস, রক্তে রাঙ্গানো ফেব্রুয়ারি মাস, ভাষা আন্দোলনের মাস শুরু হলে আজ সোমবার। বাঙ্গালী জাতি পুরো মাস জুড়ে শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানাবে ভাষা শহীদদের প্রতি।এই মাসকে ঘিরে অমর একুশের বই মেলা সহ নানান কর্মসূচি ও উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে আসছে।
শতাব্দীর ভয়াবহ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি করোনা মহামারি সংকটে পড়ে এবার ফেব্রুয়ারিতে থাকছে না অমর একুশের বই মেলা। বাংলা একাডেমি জানিয়েছেন, এবার মেলা শুরু হবে ১৮ মার্চ। শেষ হবে পয়লা বৈশাখ তথা ১৪ এপ্রিল। মহামারির কারণে এ প্রথম যেতে হলো প্রথার বাইরে তবে এতে নতুন আরেক আনন্দও যোগ হয়েছে। তা হচ্ছে এবার বইমেলা হবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে।
মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে আনার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছে বাংলা মায়ের ধামাল ছেলেরা। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সে আত্মদানের কথা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের স্বীকৃতির ফলে কার্যত ভাষা শহীদরাও বিশ্বব্যাপী বিরল সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। হাজার বছর ধরে জাতির অভ্যন্তরে যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লালিত হয়ে আসছিল কার্যত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
আমাদের এ মহান ভাষা আন্দোলন এবং তারই পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের দরবারে আমাদের গৌরবকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে। আমরা আরো বেশি গর্বিত হয়েছি যখন আমাদের ভাষা দেশের গ-ি পেরিয়ে গোটা বিশ্বের কাছেও স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আমাদেও শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’র স্বীকৃতি পেয়ে গৌরবের আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছে। আর এ মহান কাজে যারা অবদান রেখেছেন তারাও বাংলাদেশী। তারা এ জাতির কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশ্বে বাংলাভাষা জনগণের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে পাকিস্তান, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল সংখ্যক বাঙালির বসবাস। মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশ মালয়েশিয়া, কোরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী বসবাস করছেন। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের বাংলাভাষী সৈনিকদের কর্মকা-ে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আফ্রিকান দেশ সিয়েরালিয়ন বাংলা ভাষাকে সে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে থেকে পাকিস্তান ও ভারতে বাংলাভাষা অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এদিক থেকে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইতোমধ্যে মর্যাদার দাবিদার।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী বিক্ষোভ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করল। অথচ সরকার জনগণের এ দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য একই দিন ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং জারি করল ১৪৪ ধারা। কিন্তু তাতেও মানুষের ক্ষোভকে থামানো যায়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বাধা আসে পুলিশের। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে দমন করতে পুলিশ মিছিলের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্র মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে শহীদ হন, জব্বার, বরকত, সালামসহ আরও অনেকে, আহত হন বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। ২২ তারিখ নিহতদের গায়েবানা জানাজা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। এ ঘটনার পর ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠে। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে তাদের ভাষা, স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা নিরাপদ নয়। তাই ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা লড়াইয়ে মানুষ অর্জন করে মহান স্বাধীনতা।
মূলত ভাষা আন্দোলনের চেতনা হচ্ছে, জাতীয় ঐক্যের এবং জাতীয় সমৃদ্ধির। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ।
– মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।