একাত্তরের এই দিনেঃ ৯ মার্চ: মোহাম্মদ হাসান
৯ মার্চ ১৯৭১ । একাত্তর সালের আজকের উত্তাল এই দিনে ঢাকার ঐতিহাসিক পলটন ময়দান এ অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হমিদ খান ভাসানী ভাষণ দেন। বাঙালির স্বাধীনতা আন্দলনের প্রতি একাত্বতা প্রকাশ করে মাওলানা ভাসানী তাঁর চিরাচরিত দরাজ কন্ঠে ঘোষণা দিলেন, ” হে বাঙালিরা, আপনারা মুজিবের উপর বিশ্বাস রাখেন, তাকে খামোকা কেউ অবিশ্বাস করবেন না, কারন মুজিবকে আমি ভালো ভাবে চিনি ”।
মজলুম জননেতা ভাসানী পাকিস্তানের জল্লাদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে বলেন, ”অনেক হয়েছে আর নয় , তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই । লা- কুম দ্বিনিকুম অলইয়া দ্বিন’র মতো অথ্যাৎ তোমার ধর্ম তোমার , আমার ধর্ম আমার; পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও” ।
জনসভায় মাওলানা ভাসানী তুমুল করতালির মধ্যে বলেন, ” মুজিবের নির্দেশ মতো আগামি ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবো” । মাওলানা ভাসানী এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন।
মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঢাকা শহরের মিছিল-মিটিং গুলোতে দেখা যাচ্ছিল সবুজ জমিনের উপর লাল বৃ্ত্তের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা।
আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয়-সহ সারাদেশে সকল সরকারি ও আধাসরকারী অফিস, হাইকোর্ট ও জেলাকোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কেবল সেসব অফিস চালু থাকে।
গভীর রাতে ইসলামাবাদে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে “খ” অঞ্চলের সামরিক শাসক নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ ৭ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। টিক্কা খান ৭ মার্চ ঢাকা আসেন। ৬ মার্চ তাঁকে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। আজ তাঁর গভর্নর হিসেবে কার্যভার গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতাল চলাকালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতিগণ নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাঁদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকাস্থ জাতিসংঘের উপ আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দফতর পূর্ববঙ্গে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ” এর ছাত্রসভায় গৃহীত “স্বাধীন বাংলাদেশ” ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘন্টার জন্য কারফিউ জারি করেন। রাজশাহীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন নৈশ কারফিউ জারির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে ঘোষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বোধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
সকালে পিআইএ-র বাঙালি কর্মচারীরা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলে তিনি তাঁদের সাক্ষাৎদান করেন।
এদিকে ৯ মার্চ, ১৯৭১ মঙ্গলবার গঠিত হয় বাগেরহাট সংগ্রাম কমিটি। স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলো নিয়ে গঠিত সর্বদলীয় এ কমিটির নাম দেওয়া হয় “বাগেরহাট মহকুমা সংগ্রাম কমিটি”। কমিটি যথারীতি তাদের কর্মসূচি প্রণয়ন করে এবং পরবর্তিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের কর্মকান্ডে অংশ নেয়।
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।