প্রাণের ৭১

আজ সৌভাগ্যের রজনী শব-ই-বরাত: মোহাম্মদ হাসান

আজ ২৯ মার্চ সোমবার দিনের সূর্য অস্ত গেলেই এক অপার্থিব পবিত্রতায় আবৃত রজনীর আবির্ভাব ঘটবে এবং আগামীকাল মঙ্গলবার সূর্যোদয় অবধি এ রাতের মহিমাময় ফজিলত অব্যবহিত থাকবে।

মহিমান্বিত এ রাতে মহান আল্লাহর কাছে পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিষ্কৃতি লাভের পরম সৌভাগ্যের রজনী শব-ই-বরাত বা মুক্তির রাত। মধ্য শাবান হচ্ছে আরবি শা’বান মাসের ১৫ তারিখ, যা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে শবে বরাত বা শব-ই-বরাত নামে পালিত একটি পুণ্যময় রাত। ‘শব-ই-বরাত’ দু’টি শব্দের সমষ্টি। প্রথম শব্দটি ‘শব’ ফারসি শব্দ, যার অর্থ রাত রজনী। দ্বিতীয় শব্দটি ‘বরাত’ আরবি শব্দ, যার অর্থ মুক্তি। এভাবে শব-ই-বরাত অর্থ মুক্তির রাত। বাংলা ভাষায় বরাত শব্দটি ব্যবহৃত ও প্রচলিত যার অর্থ ভাগ্য, অদৃষ্ট। এ ক্ষেত্রে শব-ই-বরাত অর্থ হবে ভাগ্যরজনী।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানগণ বিভিন্ন কারণে এটি পালন করেন। তবে এক এক দেশে এই মহিমান্বিত রজনীর নাম আলাদা আলাদা। আমাদের দেশে এই রাত ‘শবেবরাত’এবং লাইলাতুল বরাত নামে পরিচিত। হযরত ইমাম বাগবী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, (হযরত মুহাম্মদ ইবনে মাইসারা ইবনে আখফাশ (রহঃ) থেকে) তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, শাবান মাস থেকে পরবর্তী শাবান মাস পর্যন্ত মৃত্যুর ফায়সালা করে দেয়া হয়। এমনকি লোকেরা যে বিবাহ করবে, সেই বছর তার থেকে কত জন সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তার তালিকা এবং তার মৃত্যুর তালিকাও প্রস্তুত করা হয় ওই বছরের অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শবেবরাতে।

শবে বরাত ভাগ্যবণ্টনের রাত : শবে বরাতের অন্যতম একটা ফজিলত হচ্ছে, এই রাতে সৃষ্টিজগতের ভাগ্যবণ্টন করা হয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি মুবারকময় রাতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী, এই রাতে হিকমতপূর্ণ সব বিষয় সিদ্ধান্ত করা হয়। [সূত্র: সুরা দুখান, আয়াত:২-৩]। এই রাতে হিকমতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। তাই এ রাতকে ভাগ্য রজনী বা মুবারক রাত বলা হয়।

শবে বরাতে রাত জেগে ইবাদত করা ও পরদিন রোজা রাখা : শবে বরাতে মহান আল্লাহতায়ালা রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। এই রাতে উদার চিত্তে ক্ষমা করে দেন। অতএব এই রাতে এমনই কাজ করা উচিত হবে, যা আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগী হবে। আর এমন সব কর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে, যা রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার অন্তরায় হবে। আল্লাহ্র রহমত লাভে সহযোগী হয় এমন কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কয়েকটি কাজ হলো- একাগ্রচিত্তে নফল নামাজ পড়া, মনোযোগসহ বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা, রাত জেগে অশ্রুবিজড়িত অবস্থায় আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, মঙ্গল কামনা ও দিনে রোজা রাখা ইত্যাদি। এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদিস- হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক রাতে রাসূল (সাঃ) নামাজের জন্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। হাদিসের শেষাংশ হচ্ছে- এই রাতটি হলো শবে বরাত। এই রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ করুণার দৃষ্টি দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের দয়া করেন। তবে হিংসুক ব্যক্তিদের স্বীয় অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। [সূত্র: বায়হাকী, খ–৩, পৃ:৩৮৩; আততারগিব, খ-: ২ পৃ: ৭৩-৭৪]

হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে, (হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত) তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যখন শা’বানের পনের তারিখ রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাত্রিতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, “কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কোনো রিযিক প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তাকে রিযিক দান করব। কোনো মুছিবতগ্রস্থ ব্যক্তি আছ কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিব। এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।” সুবহানাল্লাহ! (ইবনে মাজাহ্, মিশকাত)। হাদীছ শরীফ-এ আরো ইরশাদ হয়েছে- ‘যারা ১৪ শাবান রজনীতে ইবাদত করবে তাদের জন্য মুক্তি। আর যে ব্যক্তি পরদিন রোজা পালন করবে, জাহান্নামের আগুন তাকে স্পর্শ করবে না।’ পবিত্র এ রজনীতে ফজিলত ও ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম। নবী করিম (সাঃ) স্বয়ং এ রাতের অর্ধেক সিজদার মাধ্যমে অতিবাহিত করতেন।

রাসূল (সাঃ)-এর হাদিসে এবং প্রখ্যাত আলেম-ওলামা ও তাফসীরকারীগণ শবেবরাতের বহু তাৎপর্য এবং এই রাতের মহিমার কথা উল্লেখ করেছেন। এই রাত সম্পর্কে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এরশাদ করেছেন, এই রাতে ইবাদতকারীদের গুনাহরাশি আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দেন। তবে কেবলমাত্র তারা ক্ষমার অযোগ্য যারা আল্লাহর সাথে শিরিককারী, সুদখোর, গণক, যাদুকর, কৃপণ, শরাবী (মদ্যপানকারী), জিনাকারী এবং পিতা-মাতাকে কষ্টদানকারী।

অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, জিব্রাইল (আঃ) আমাকে বলেছেন, আপনি আপনার উম্মতদের জানিয়ে দিন, তারা যেন শবেবরাত রাতকে জীবিত রাখে।’ অর্থাৎ তারা যেন এ রাত ইবাদতের মাঝে কাটিয়ে দেয়।

রাসূল (সঃ) আরেকটি হাদিসে বলেছেন, ‘এই রাতে আসমান থেকে ৭০ হাজার ফেরেশতা জমিনে এসে ঘুরে ফিরে ইবাদতকারীগণকে পরিদর্শন করেন এবং তাদের ইবাদতসমূহ দেখেন।’ অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে ইবাদত করবে এবং দিনে রোজা রাখবে, দোজখের আগুন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

সর্বোপরি পুরো রাত্রিই অতিবাহিত করতে হবে পবিত্র যিকির-ফিকির, তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে। যাতে মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। আর পবিত্র শবে বরাতে আল্লাহ পাকের পূর্ণ নিয়ামত লাভের জন্যে সর্বোত্তম উসিলা বা মাধ্যম হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ [সঃ] আলাইহিস সালাম। তাঁর পবিত্রতম ছোহবত মুবারকে থেকে সারারাত্রি জাগরণ ও পবিত্র সুন্নাত মুতাবিক মক্ববুল দোয়া, মক্ববুল মুনাজাত শরীফ তাঁর মধ্যে শরীক হওয়া, অতি উত্তম ও সহজ পদ্ধতিতে পবিত্র রাত্র ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করা এবং পরবর্তী দিনে রোযা রাখা।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*