প্রাণের ৭১

একাত্তরের এই দিনেঃ ৩০ মার্চ -মোহাম্মদ হাসান

উত্তাল ৩০ মার্চ ১৯৭১ঃ এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আধিপত্য ভাঙ্গতে পাকিস্তানী জান্তা রিজার্ভ সৈন্যদেরও সবদিকে পাঠাতে শুরু করে। তবে প্রতিরোধের মুখে পড়ে সর্বত্র। ভারতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠক ডাকেন ইন্দিরা গান্ধি। কয়েক লাখ শরণার্থীর পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার খবর শিরোনাম হয়ে ওঠে বিশ্বগণমাধ্যমে।

এই দিনে দুপুরের মধ্যে পাকসেনারা চট্টগ্রাম পোর্টের দিক থেকে বরফকল সড়ক হয়ে এখানে পৌছে যায় এবং সদরঘাট, রেলওয়ে ষ্টেশন এবং স্টেডিয়ামের দিকে তারা অগ্রসর হতে থাকে। ছোট একটি দল কোর্ট হিলের দিকেও পা বাড়ায়। কিন্তু হিলে অবস্থানরত ইপিআর সৈনিকদের বুলেট বৃষ্টিতে পাকিস্তানীদের পিছু হটে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়।

একই দিনে হালিশহরেও সকাল ৮টা থেকে সংঘর্ষ চলতে থাকে। পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে কামান দেগে চলছিল। নৌবাহিনীর সবগুলি কামানই তখন সক্রিয় ছিল। ক্রমাগত ৬ ঘন্টা যাবত তারা হালিশহরের উপর গোলাবর্ষণ করে। কামানের ছত্রছায়ায় শত্রুরা হালিশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইপিআর সেনাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে অগ্রগতি লাভে ব্যর্থ হয়ে শত্রুরা বিমান বাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করে। আধ ঘন্টার মধ্যে দুটি বিমান চলে আসে। এবং বেলা সাড়ে বারোটা থেকে ইপিআর অবস্থানের উপর ক্রমাগত বিমান হামলা চলতে থাকে।বিমান হামলায় চট্টগ্রাম কালুরঘাট ট্রান্সমিটারটি বিধ্বস্ত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বীর শব্দ সৈনিকগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার নিয়ে রামগড় হয়ে আগরতলা চলে যান।
বিকালের মধ্যে শত্রুরা হালিশহর দখল করে নিল। হালিশহর পতনের পর শত্রুদের পুরো দৃষ্টি পড়লো কোর্ট হিলের উপর। এটাই ছিল শহরে সর্বশেষ ঘাটি, সর্বশেষ আশা। বিভিন্ন দিক থেকে অবস্থানটির উপর কয়েকবারই হামলা হল। কিন্তু প্রতিবারই ইপিআর সৈন্যরা তা প্রতিহত করে! এরপর এল ট্যাংক বহর। অগ্রবর্তী ট্যাংকটি পাকা রাস্তা বেয়ে উপরের দিকে উঠতেই আমাদের সৈন্যদের ট্যাংক বিধ্বংসী শেলের আঘাতে তা অকেজো হয়ে পড়লো। ট্যাংকটি অকেজো হয়ে থেমে পড়লে পেছনে অন্যান্য ট্যাংক এবং পদাতিক সৈন্যরা কিছুটা থমকে দাঁড়ালো। পরবর্তীতে তারা জোরালো আক্রমন করলে ইপিআর বাহিনি পশ্চাদপসরণ করে।

এদিকে চট্টগ্রাম থেকে এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান এবং আব্দুল্লাহ আল হারুন সাব্রুম সীমান্ত দিয়ে আগরতলা পৌঁছান। আগরতলা শচীন সেনগুপ্তের কাছে আওয়ামী লীগ নেতাগণ অস্ত্রশস্ত্রের সহায়তার আবেদন জানান।
ঢাকার পরে চট্টগ্রাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দুদিনের মধ্যেই পাকস্তানি সামরিক জান্তার লেলিয়ে দেয়া বাহিনী প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সংবাদ পায় ৩০ মার্চ বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ নতুন নতুন ফ্রন্টে পাকসেনা নিহতের।

যশোরের খন্ডযুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসে পাকসেনারাই উর্দ্ধতনদের জানান, মুক্তিসেনাদের বীরত্ব। নতুন করে সাতক্ষিরাসহ আরো কিছু এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটির খবরে উদ্বিগ্ন পাকজান্তা সারাদেশে পাঠাতে শুরু করে রিজার্ভ সেনাদের। তবে এদিন খোদ ঢাকায় চোরাগুপ্তা হামলা করতে গিয়ে ধরা পরে দুই গেরিলা, ঢাকাতেও আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তল্লাশী শুরু হয়।
জীবন বাঁচাতে এপারের মানুষের ঢল নামে ওপার বাংলায়, সেসময়ের বিশ্বগনমাধ্যমে প্রতিবেদনে দিনে আড়াই লাখ। বাঙালী নারী-শিশু-বৃদ্ধদের সীমান্ত পারের এমন মানবিক বিপর্যয় ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময়ও হয়নি। কোলকাতায় প্রথমে খোলা হয় ত্রাণ কার্যালয়, পরে দ্রুত সময়ে ক্যাম্প গড়ে ওঠে।

এদিন অটল বিহারী বাজপায়ীর নেতৃত্বে বাজপেয়ীর নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের মিছিল হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। প্রগতিশীল বামপন্থী সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ অব্যাহত কোলকাতা ও দিল্লীতে। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস দলীয় মূখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় রাস্তায় নামেন উদ্বাস্তুদের ত্রানের চাঁদা তুলতে। নক্সালকর্মীরাও এগিয়ে আসেন সহায়তায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধি মন্ত্রীদের খবর পাঠান, পরের দিন জরুরী বৈঠকে যোগ দিতে।

বাংলার স্বজনদের কাছে যেতে আগের দিনের মত সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করে পশ্চিমবাংলার যুবকেরা।
স্বধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকবাহিনীরা সারাদেশে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের একেটি দিন মানে নরকের চেয়েও ভয়বহ দিন হয়ে উঠে বাঙালিদের কাছে। দেশবাসী কোনো কূলকিনারা না পেয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলতে থাকে।

১৯৭১ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের লালখান বাজারে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী ও বিহারী এবং রাজাকাররা মিলে হত্যা করে প্রায় আড়াই হাজার বাঙালী। ‘ওয়াসার মোড়ের কল হতে পানি দেওয়া হচ্ছে’ এমন প্রতারণামূলক গুজব রটিয়ে জড়ো করা হয় বাঙালীদের। এরপর হানাদার সেনারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে শত শত বাঙালীকে। এরপর ওই দিন দুপুর থেকে বাঙালী দেখা মাত্রই গুলি করে হত্যা করতে থাকে হানাদাররা। রাতেই চলে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানুষ হত্যা। চট্টগ্রামের লালখান বাজার পুরো মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে।

৩০ মার্চ দিন নাটোরের লালপুরে ‘ময়নার যুদ্ধে’ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে সাঁওতাল ও বাঙালীরা। এই সম্মুখ যুদ্ধে সাঁওতাল তীরন্দাজসহ ৪০ জন বাঙালী শহীদ হন। সেদিন মুক্তিপাগল জনতা, তৎকালীন ইপিআর ও আনসার বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হয় ২৫ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।

একাত্তরের এই দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের পার্লামেন্টে বলেন, “পূর্ব বঙ্গের সাড়ে সাত কোটি লোক তাদের স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম শুরু করেছেন, ভারত তাকে সাহায্য না করে পারে না। ভারত তাই সংগ্রামে সাহায্য করেই যাবে।”
একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে শহীদজননী জাহানারা ইমাম ৩০ মার্চ সম্পর্কে লিখেছেন— “সুফিয়া কামাল আপা, নীলিমা ইব্রাহিম আপা বেঁচে আছেন। কলকাতা রেডিওতে ভুল খবর দিয়েছে। খবরটা জেনে মনটা খুব ভাল হল।”

অবস্থা বেগতিক দেখে মেজর জিয়া দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৩০ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবারও ঘোষণা দেন যে, ‘পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনী বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত আক্রমণ শুরু করেছে এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে।’ তিনি তাঁর ঘোষণায় বলেন, ‘আমি এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ এবং আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য আবারও জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। বিলম্ব করা হলে আরও লাখ লাখ লোক নির্মম হত্যার শিকার হবে।’

তথ্য সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রকাশিত প্রতিবেদন।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*