সংগ্রাম গৌরব অর্জনে ৭২ পেরিয়ে ৭৩-এ আওয়ামী লীগ: মোহাম্মদ হাসান
২৩ জুন, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের জন্য এক ট্রাজেডির দিন। আজ থেকে ২৬৪ বছর আগে ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীর আম্রকাননে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার শেষ সূর্য অস্ত গিয়েছিল। মীর জাফর আলী গংদের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন ঘটেছিল। পলাশী যুদ্ধে বেদনাদায়ক পরাজয়ের পর সিরাজের মৃত্যু হলেও এই দিনটিকে উপমহাদেশের মানুষ এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
আবার ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার দিন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর ১০ মাসের মধ্যে পুরোনো ঢাকায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এক রাজনৈতিক কর্মিসম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ ৭২ বছর ধরে রাজনীতির অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগের ইতিহাস সংগ্রাম, সৃষ্টি, অর্জন ও উন্নয়নের ইতিহাস। আওয়ামী লীগ ছিল পাকিস্তানে প্রথম কার্যকর কোনো বিরোধী দল। শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগের যাত্রাই শুরু হয় বাঙালিদের স্বার্থে সত্যিকার ও আপসহীন প্রতিনিধি হিসেবে। তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রে কোনো বিরোধী দল গঠন কিছুতেই সহজসাধ্য ছিল না। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু আর সব বাধা-প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শুধু প্রতিষ্ঠা লাভই সেদিন ঘটেনি, অতি দ্রুত এর জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুনের এই দিনে ঢাকার রোজগার্ডেনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক এবং বঙ্গবন্ধু যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিলো। মুসলিম লীগ ছিলো খাজাদের পকেটে এবং খাজা পরিবারের আওতায় সীমাবদ্ধ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম সারাজীবন চেষ্টা করেছেন মুসলিম লীগকে খাজাদের পরিবারের দেয়াল ভেঙে, মওলানা আকরম খাঁর পকেট থেকে বের করে জনগণের মুসলিম লীগ করতে। মুসলিম লীগ ছিলো একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ রোপন করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। মওলানা ভাসানীও ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। এরাই পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ জন্ম দেন। এর অর্থ ‘জনগণের মুসলিম লীগ’।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর পরই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। জিন্নাহ এ দেশে কোনো বিরোধীদল গঠন করার পক্ষপাতী ছিলেন না। পাকিস্তান ছিলো একটি আমলা আর্মি নির্ভর স্বৈরাচারি, ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালি মধ্যবিত্তরা আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন।
জন্মের পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা থামে নি। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বার্তাবরণে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা। আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পূর্বলগ্নে, পঞ্চাশের দশকের সূচনায় আওয়ামী লীগের জন্ম। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ছিলো না। সম্পূর্ণ ভাবেই বাঙালির স্বার্থ, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ভিত্তিক দল ছিলো। যে চেতনার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো, সেই চেতনার বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের অস্ত্র ছিলো ইসলাম। মওলানা মওদুদীর অস্ত্রও ছিলো ইসলাম। আওয়ামী লীগের অস্ত্র ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই উপমহাদেশে আওয়ামী লীগকে অবলম্বন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ সাংবিধানিক মর্যাদা পায়। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। আওয়ামী লীগ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কতটা নেতৃত্ব দিয়েছে, সেটা নিয়ে কূটতর্ক করতেই পারেন প্যাচকষাণো পন্ডিতরা, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ভাষা আন্দোলনের চেতনা পুরোটাই ধারন করেছিলো। বাংলাদেশ ভাষা ভিত্তিক দেশ। ভাষা ভিত্তিক আন্দোলনকে জাতির জনক বঙ্গন্ধু শেক মুজিব দেশ ভিত্তিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে বলা হয় জাতিরাষ্ট্র। কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরই ফসল আজকের বাংলাদেশ। গোড়া থেকেই বলা হয়েছে বাংলাদেশ হবে বাঙালি জাতির রাষ্ট্র। এই গৌরব আওয়ামী লীগের, একটি ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠন করে দিয়েছে।
ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে, বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর তাবৎ ঐতিহ্য অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে বাঙালির জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ‘মুসলিম‘ শব্দটি আওয়ামী লীগের নাম থেকে ঝরে যায়। হয়ে দাঁড়ায় ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। সেই থেকে আজো অব্দি এ দেশের সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ছায়া তলে এসে দাঁড়িয়েছে; আর নড়ে নি। তারা অসাম্প্রদায়িক দল আওয়ামী লীগকেই ভালোবাসে। এ জন্য তাদের অনেক গাল-মন্দ শুনতে হয়। এ দেশের সেরা মনীষী, লেখক, কবি, শিল্পী, ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানী-দার্শনিকরা আওয়ামী লীগ গঠনে এবং তার বিকাশে অবদান রেখেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন না হলে বাঙালি জাতির কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। বাঙালির জীবনে বাংলা ভাষা থাকতো না, রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত থাকতো না। বাঙালি সংস্কৃতি থাকতো না। বাঙালিরা যাযাবর জাতিতে পরিণত হতো। পাকিস্তান ইসলামের নামধারী একটি মধযুগীয় বর্বর রাষ্ট্র ছিলো, তার সমস্ত অত্যাচার প্রথমে নেমে আসে কম্যুনিস্ট পার্টির ওপর তার পর আওয়ামী লীগের ওপর। কৃষক নেত্রী ইলামিত্রের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিলো পাকিস্তানি শাসকরা, কারাগারে তার গুপ্ত অঙ্গের ভেতর সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। এটা কি ইসলাম সম্মত ছিলো?
একদিকে বাঙালিদের শোষণ করেছে, অন্যদিকে ইসলামের দোহাই পেড়েছে, ভারত জুজুর ভয় দেখিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকদের জুলুম, অত্যাচার, মিথ্যাচার, ধর্মের ফতোয়া, ধর্মীয় অপবাদ মোকাবেলা করেছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের চীনপন্থীরা, মওদুদী পন্থীরা, একশ্রেণির আলেম,ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানি শাসকদের সমর্থন দিয়েছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানি দালালরা বলেছে, ‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম থাকবে না।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বলেছেন, ‘জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভাল না, তখন এক দাবার ঘুঁটি চালালেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। গোপালগঞ্জে আমার নিজের ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্ম গ্রহণ করেছেন। আমি তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ঠ জ্ঞান রাখেন। আমার ধারণা ছিলো মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচারণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি করত। মওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে স্পিডবোটে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্মসভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, ‘আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ সাথে শরষীণার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমত পুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন।’ ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী- পৃঃ২৫৬)।
তাহলে চিন্তা করতে হবে আওয়ামী লীগকে কতবড় প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সামনে অগ্রসর হতে হয়েছে। কত ফতোয়া মোকাবেলা করতে হয়েছে। বাংলাদেশে যত দরগা, খানকা শরীফ, পীরের আস্তানা আছে, তার সকলেই আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করেছে। পাকি শাসক, মুসলিম লীগ ও জামায়াতের লোকজন এ সব পীরদের বুঝিয়েছে যে, আওয়ামী লীগ একটি ইসলাম বিরোধী দল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ভারত দেশ দখল করবে। মুসলমানরা পরাধীন হবে। এই ধর্মান্তরী অপবাদ আওয়ামী লীগ মোকাবেলা করেছে। আট রশীর পীর হাসমত উল্লাহ ফরিদপুরী যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিনই মুসলিম লীগ সমর্থন করেছেন, আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছেন।
আওয়ামী লীগের দু’জন সভাপতি ছিলেন বিখ্যাত মওলানাঃ মওলানা ভাসানী এবং মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তারপরও আওয়ামী লীগকে ইসলামের শত্রু প্রতিপন্ন করতে ছাড়েনি পাক শাসকরা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগকে বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যেদিন থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব হাতে নেন, সেদিন থেকেই দলের প্রধান ভূমিকা পালন করতে থাকেন। তিনি ১৯৫৭ সালে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছেন দলের স্বার্থে। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে তিনি গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন, তারপর দেশ স্বাধীন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে আওয়ামী লীগকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, তার বিজয়ের যাত্রা অব্যাহত আছে। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। দীর্ঘ ২১ বছর তিনি লড়াই করেছেন। তারপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি আওয়ামী লীগকে তাঁর নিজস্ব মডেলে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বাকশাল সিস্টেমে না গিয়ে সংসদীয় সিস্টেমে আওয়ামী লীগকে নতুন করে গড়ে তোলেন। তিনিও অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেন। অনেক বদনাম তাঁকেও হজম করতে হয়। তিনি আওয়ামী লীগকে পচাঁত্তর পরবর্তী বিপন্ন অবস্থা থেকে আবার ২০০১ সালের বিপন্ন দশা থেকে উদ্ধার করে বিপুল পরিশ্রম এবং অসামান্য কৌশল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় চলে আসেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ বলতে গেলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।