জাতিকে এগিয়ে নিতে ছাত্রলীগ কাজ করে যাবে নিরন্তর: মোহাম্মদ হাসান
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটির দীর্ঘ পথচলায় রয়েছে দেশ ও জাতির জন্য গৌরবময় অসংখ্য অর্জন। সমৃদ্ধ সেসব অর্জন জাতিকে দিয়েছে নতুন পথের ঠিকানা। স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের যেভাবে হলো, সে শব্দ প্রাপ্তিতে সংগঠনটির অবদান ইতিহাসের পাতায় আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন দাবি ও প্রেক্ষাপটের আলোকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে; সর্বোপরি সাংগঠনিক প্রয়োজনীয়তা ও সংঘবদ্ধভাবে সফল আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই জাতির পিতা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের সরব উপস্থিতি এবং সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ে ছাত্রলীগের ভূমিকা জাতির পিতা তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, ‘আওয়ামী লীগ গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরত। ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের নেতাকর্মীদের অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠানকে খতম করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করে নাই।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা নং-২৩৬)।
বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে কোনো কাজ করতে চাইলে অধিকাংশ সময় তা ছাত্রলীগ দিয়ে শুরু করতেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন ছাত্রনেতাদের চিঠি লিখে আন্দোলনের গতি বেগবান করতে দিকনির্দেশনা দিতেন। বলা যায়, ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং তাদের সংগঠিত করার প্ল্যাটফরম হিসেবে তিনি ছাত্রলীগকে প্রাধান্য দিতেন। দেশের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, একাত্তরের ১৭ হাজার নেতাকর্মীর আত্মত্যাগে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, তথাকথিত এক-এগারো সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-ইতিহাসের সবখানেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। গর্বের সঙ্গে বলা যায়, যে কোনো সংকটে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রয়েছে অনন্য অবদান।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে অস্ত্রের প্রবর্তন করেন। তিনি ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে এ দেশের মেধাবী শ্রেণিকে বিপথগামী করে তোলেন। সেখান থেকে ছাত্রবান্ধব নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর মতিঝিল শাপলা চত্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পুনর্মিলনীতে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি একেএম এনামুল হক শামীম এবং সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার হাতে বই, খাতা ও কলম তুলে দিয়ে আবারো ইতিবাচক ধারায় বাংলার ছাত্রসমাজকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে নিয়ে আসেন। ছাত্ররাজনীতিতে বলা যায়, এক নবযুগের সূচনা ও মেধাবী ধারা প্রবর্তন করেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিভিন্ন সময় দিকনির্দেশনা ও উপদেশ দিয়ে থাকেন-অস্ত্র নয়, কলমের শক্তির প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সব সময়।
বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, বক্তৃতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদানের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস’, ‘দেশ গড়ার জন্য সোনার ছেলে চাই; সেই সোনার ছেলে গড়ার কারিগর ছাত্রলীগ’। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম। জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতনে বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল জর্জরিত। তার যৌবনের ১৩টি বছর কেটেছে পাকিস্তান কারাগারে। ১৯৬৯ সালে ২১ দফা আন্দোলনের ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জেল থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জাতির পক্ষ থেকে বক্তৃতার করে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনকর্মের সঙ্গে তাই ছাত্রলীগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত; এটি চিরন্তন সত্য।
বঙ্গবন্ধুর নিজের প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগকে ছাত্রদের মাঝে একটি জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে তারই সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের কাছে একটি জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির ইতিবাচক ধারণা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এসেছে। ছাত্ররাই ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্ব দেবে-এ উপলব্ধি থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার বয়সসীমা ২৭ বছর নির্ধারণ করে দেন; যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
ইতিহাস বলে, দেশের যে কোনো সংকটকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার সর্বোচ্চ দিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রদল ও শিবিরের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অছাত্রদের সংগঠন ছাত্রদল ও রগকাটা বাহিনী ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয় আনে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনকে বিনা কারণে গ্রেফতার করে কারাগারে অন্তরিন করে রাখে। ওই সরকারের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদককে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২০০৭ সালের ২৭ জুলাই দিনটি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এক কালদিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য বাংলা ও বাঙালির প্রিয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সুধাসদন থেকে যৌথ বাহিনী দ্বারা গ্রেফতার করে। নেত্রীর মুক্তির দাবি করে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে জজকোর্টের সামনের রাস্তা অবরোধ করে। সে দিনের মিছিল আলোড়ন সৃষ্টি ও শাসকগোষ্ঠীর মাঝে ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। বাংলার গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রবল চাপে ও আন্দোলনের মুখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার নেপথ্যে রয়েছে ছাত্রলীগের অবদান। এছাড়া সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম সারা বাংলাদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সেভ ক্যাম্পাস ক্লিন ক্যাম্পাস’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ‘সেভ ক্যাম্পাস ক্লিন ক্যাম্পাস’ কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রলীগকে ইতিবাচক কর্মসূচিতে যুক্ত করেন সজীব ওয়াজেদ জয়; যা নতুন করে ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের মাঝে প্রভাববিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে ধারাবাহিকতায় সদ্য বিদায়ী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ছাত্রলীগকে নিয়ে গেছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়; বিশেষ করে বৈশ্বিক এ করোনাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কর্মহীন ও অসহায় হয়ে পড়া দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। শুধু ত্রাণ কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ নয়, করোনায় মৃতদের লাশ দাফনের মতো মহান কাজও করেছে ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এমন মানবিক আচরণ সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
সূর্যের আলোর মতো তেজোদীপ্ত হয়ে গণমানুষের অধিকার আদায়ে নিয়মিত রাজপথে সোচ্চার এবং ছাত্রসমাজের অভিভাবক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বর্তমান সময়েও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্রসমাজের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। জাতির পিতার নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাবে নিরন্তর, সে প্রত্যাশা রইল। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরবময় ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং অসংখ্য নেতাকর্মীদের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম ও শুভেচ্ছা।
লেখক: মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী।