মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং বিচার
১৯৭১-এর ৯ মাসে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে সেটি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের কোথাও এ ধরনের গণহত্যা ঘটেনি। ’৭১-এর গণহত্যার একটি ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি হচ্ছে তালিকা প্রস্তুত করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জামায়াতের দলীয় ঘাতক বাহিনী ‘আলবদর’ এই বুদ্ধিজীবী হত্যা কার্যকর করেছিল, যার নীলনকশা প্রণয়ন করেছিলেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা।
জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘকে রূপান্তর করা হয়েছিল ‘আলবদর’ বাহিনীতে, যার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র সংঘের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামরুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী, চৌধুরী মঈনউদ্দিন, আশরাফউজ্জামান প্রমুখ; ২০১০ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার হয়েছে এবং অনেকের প্রাণদণ্ড ইতিমধ্যে কার্যকরও হয়েছে। একটি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য এই বুদ্ধিজীবী হত্যা সংঘটিত হয়েছিল- স্বাধীন হলেও বাঙালি কখনও যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।
আমরা ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, কারণ এদিন আলবদরের ঘাতকরা সর্বাধিকসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যা আরম্ভ হয়েছিল ১৯৭১-এর ১৫ নভেম্বর থেকে। সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই তরুণ চিকিৎসক ডা. আজহারুল হক এবং ডা. হুমায়ূন কবিরকে আলবদরের ঘাতকরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নৃশংস নির্যাতন করে হত্যা করে রাজধানীর মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের পাশে লাশ ফেলে রেখেছিল।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর মিরপুরের বিভিন্ন বধ্যভূমি ও রায়ের বাজারে বুদ্ধিজীবীদের হাত-পা বাঁধা, চোখ বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে মানুষ আতঙ্ক ও ক্ষোভে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। হত্যার আগে নৃশংসতম নির্যাতন করা হয়েছিল বরেণ্য লেখক, সাংবাদিক, কবি, চিকিৎসক, অধ্যাপক ও অন্য পেশাজীবীদের।
বুদ্ধিজীবী হত্যার শিরোমণিদের বিচার হলেও রাজাকার, আলবদর ইত্যাদি ঘাতক বাহিনী এবং তাদের স্রষ্টা জামায়াতে ইসলামী এবং সহযোগী সংগঠনের বিচার হয়নি। অধিকাংশ শহীদ পরিবার তাদের আপনজনের ঘাতকদের ব্যক্তিগত পরিচয় জানেন না, তারা চেনেন সংগঠন।
১৯৭১-এ নিজামী-মুজাহিদ গং কাউকে ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত হত্যা করেননি। দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা ছিল জামায়াতে ইসলামীর দলীয় সিদ্ধান্ত, যা ঘাতক বাহিনীর সদস্যরা কার্যকর করেছে। ’৭১-এর গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকে ধর্মের নামে বৈধতা দেয়ার জন্য জামায়াতের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, এরা ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের দালাল’, ‘পাকিস্তানবিরোধী’, ‘ইসলামের দুশমন’ ইত্যাদি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে প্রথম বছরই ২১ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর পাশাপাশি সাতটি সংগঠনেরও বিচার হয়েছিল। বিচারে চারটি সংগঠন দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তাদের সবরকম কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ট্রাইব্যুনাল গঠনের নয় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ঘাতক সংগঠনগুলোর বিচার এখনও শুরু হয়নি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যাকারী সংগঠনগুলোর বিচার না হলে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার এবং বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতিকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হবে এবং ঘাতক সংগঠনগুলো ভবিষ্যতে আরও গণহত্যায় উৎসাহিত হবে।
শাহরিয়ার কবির : লেখক ও সাংবাদিক