প্রাণের ৭১

স্নেহের খোকা থেকে মুজিব-বঙ্গবন্ধু-জাতির পিতা-মোহাম্মদ হাসান

পিতা-মাতার পরম স্নেহের খোকা। দুঃসাহসী বলিষ্ঠতা নিয়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রীর পথরোধ করে দাঁড়াল। উদ্দেশ্য, বিদ্যালয় ভবনের ছাদ মেরামত না করলে বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে ছেলেদের ভিজেই ক্লাস করতে হয়, তার সমাধান। কালক্রমে এই বালক যৌবনে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় রাজনীতিতে যোগ দিলেন।

যুবক শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে করতে ক্রমশ পোক্ত রাজনীতিবিদে পরিণত হচ্ছিলেন। যেখানেই অন্যায়, সেখানেই শেখ মুজিব প্রতিবাদকারী বলিষ্ঠ সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হলো। এর মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিক্রিয়ায় যখন পূর্ব বাংলা ক্রমশ গর্জমান, সেই সময় এলো ১৯৫২ সাল। বাংলার ছাত্র সমাজ খুনে রাঙা ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রমাণ করে দিল, বাংলার তরুণ ছাত্ররা অন্যায়ের কাছে মাথানত করতে রাজি নয়। এ সময় শেখ মুজিব ফরিদপুর জেলা কারাগারে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে আটকে ছিলেন। তিনি বন্দি; কিন্তু অনশন ধর্মঘট করে জানালেন সংহতি।

১৯৬৬ সালে তিনি বাংলার মানুষের অধিকার আদায়, শোষণ-পীড়নের প্রতিবাদে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করলেন। এই দাবির প্রতি আইয়ুব খানের সামরিক সরকার কর্ণপাত না করলেও পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এর প্রতি সমর্থন জানাল। মুসলিম লীগের শাসন-শোষণ, সামরিক জান্তার দমন-পীড়ন এবং কপট ও বিভ্রান্তিকর অবস্থানের বিরুদ্ধে বাংলার অমিততেজ মানুষ নিঃশঙ্কচিত্তে শেখ মুজিবের দেওয়া ৬ দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলো। এরই মধ্যে ১৯৬৯ এসে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দিল। আসাদ, জোহা, মতিয়ুর প্রাণ দিলেন। দেশ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। কিন্তু পশ্চিমারা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাতে কোনো ক্ষমতা দেবে না। ১৯৭১-এর ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠানের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা বাতিল ঘোষণা করলেন। পুরো ঢাকা তথা পূর্ব বাংলা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আজ থেকে অসহযোগ আন্দোলন চলবে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে। আর আমি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমার বক্তব্য ও পরবর্তী কর্মসূচি তুলে ধরব।’ এলো ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দান। চতুর্দিক থেকে শত শত মিছিল ক্রমাগত আসছে আর পুরনো রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিপুল জনতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষের এই বিশাল সমাবেশ মাঝেমধ্যেই উচ্চকিত হচ্ছে, স্লোগান ধরছে- ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। দু’হাত তুলে অপেক্ষমাণ জনতার প্রতি তার স্নেহ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিংড়ে দিলেন। লিখিত বক্তব্য সরিয়ে রেখে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘ভায়েরা আমার…’। তাঁর এই অসাধারণ ১৮ মিনিটের বক্তৃতা আজ যদিও বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে; কিন্তু সেদিন রেসকোর্স ময়দানের বিস্তৃত বিশাল জনসমুদ্র মুহুর্মুহু গর্জন করে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করছিলেন আর নেতা তাঁর বক্তব্যে সরকারি প্রশাসন, সেনাবাহিনী, আওয়ামী লীগ কর্মী, জনগণ সবাইকে কী করতে হবে, তার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন- ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’; পাড়ায়-মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলবার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যাও, রক্ত যখন দিয়েছি প্রয়োজনে আরো দেবো, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ কী অনন্য উচ্চারণ, রুদ্ধশ্বাস মানুষগুলো যেন প্রতি মুহূর্তে প্রাণশক্তিকে শানিত করে প্রস্তুত হচ্ছিল অস্ত্র হাতে নেওয়ার জন্য এবং শেষ লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে। তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বিপুল জনসমুদ্র উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল, স্লোগানে চতুর্দিক মুখরিত হলো, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করেই গাড়িতে উঠে চলে গেলেন আর মানুষ নেতার যে নির্দেশ পেলেন, তা থেকেই তারা যুদ্ধের বেশ- লুঙ্গি, ধুতি কাছা মেরে, তীর-ধনুক হাতে নিয়ে ছুটলেন সবাই সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে। দখলদার পাকিস্তান বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চের রাতেই গ্রেফতার করল এবং মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে গণহত্যার সূচনা করে ঢাকার বস্তি, পিলখানায় ইপিআর ক্যাম্প ও রাজারবাগে পুলিশ সদর দপ্তরের ওপর চালাল নৃশংস আক্রমণ। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাও বাদ পড়ল না।

আমরা ৯ মাস যুদ্ধ করলাম। পেলাম স্বাধীনতা। তিনিই মহানায়ক। জাতির পিতা।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান,সাংবাদিক, কলামিস্ট।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*