প্রাণের ৭১

বিদেশী পর্যটকের সাথে অগ্রহণযোগ্য আচরণ লজ্জার- মোয়াজ্জেম হোসেন তারা

পর্যটক ফরাসী ভদ্রলোককে কুৎসিত ভাষায় তির্যক মন্তব্য করার ভিডিওটা দেখে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। মানুষের দেহে বন্য শুয়োরের বীর্য দিয়ে পরাগায়নের ব্যবস্থা করলেও সম্ভবত মানুষ এতটা কদর্য আচরণ করে না। আমি আমার কলিগ থেকে শুরু করে যেকোনো বিদেশি মানুষের সাথে গর্ব করে বলতাম তুমি কি জানো বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আছে, পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন রয়েছে যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায় তখন ওরা বলে শক্তিশালী টাইগার তো আফ্রিকাতে আছে, এমনকি আমাদের দেশের চিড়িয়াখানা গুলোতেও আছে তখন আমি ইউটিউব ঘেঁটে দেখিয়ে দিই যে, এ-ই আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ওরা এতবড় বাঘ দেখে আশ্চর্য হয়ে জানতে চাই কিভাবে সম্ভব সরাসরি দেখা?

 

আমি তাদেরকে বলি তুমি বাংলাদেশে গেলে যে হোটেলে থাকবে সেখানে যোগাযোগ করলেই দেখতে পাবে অথবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটা পর্যটন কর্পোরেশন আছে ওরাও ব্যবস্থা করবে তবে খরচটা তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি পড়বে কিংবা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমি এমন একজনকে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো যে তোমাকে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখাবে তুমি শুধু তার থাকা খাওয়া এবং যানবাহনের খরচটুকু বহন করো। কিন্তু ভিডিওতে যা দেখলাম তাতে লজ্জা থাকলে আর কখনোই ভাগাড়ে পরিণত হওয়া বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য কাউকে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করবোনা।

 

আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা ছুতোনাতা খুঁজতে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করলেও সেখান থেকে ঘুরে এসে কোন ভালো কিছু শিখে আসতে পারেনা কেন তা বুঝতে বেগ পেতে হয়না কেননা ইউরোপ আমেরিকায় বসবাস করলেও বেশিরভাগ বাংলাদেশী খচ্চরের মতো নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। তাদের কাছে মানবতার শিক্ষাতো দূর কি বাত বরং নিজস্ব কোন আইডেন্টিটিই থাকেনা যা দিয়ে নিজের মনুষ্যত্ব বিকাশের সুযোগ নিবে। এদেশের সিংহভাগই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগে ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যায় নিজের ভন্ডামীর জারিজুরি ফাঁস হইয়া যাইবোগা ভেবে মুখ লুকিয়ে সবকিছুই হালাল কইরা ঈমান মজবুত করে।

 

নিকট অতীতে গতবছর দু’বারে মোটের উপর আড়াই মাস শ্রীলঙ্কা থেকে বুঝতে পেরেছি একটা জাতি গঠনে নৈতিকতা শিক্ষা কতটুকু জরুরি যা আমাদের দেশের মানুষ কিংবা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অথচ, খুব বেশিদিন হয়নি শ্রীলঙ্কা জাতিগোষ্ঠীর বিরোধ মিটিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। এখনো দগদগে একটা ঘা নিয়ে তাদের পথচলা অথচ সবকিছু ছাপিয়ে পর্যটন শিল্পের গুণগত বিকাশে তাদের রাষ্ট্রের ভূমিকা ও জনগণের ঐকান্তিকতার অভাব নেই বরং তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় ঘাটতি আছে বলে মনে হয়নি এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আচরণে, এমনকি নাগরিকদের ভক্তি শ্রদ্ধা কোন অংশেই কম সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। শ্রীলঙ্কার মানুষদের নিশ্চিত তাদের সরকার প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, পর্যটক আসলে নিশ্চয়ই তাদের অর্থনৈতিক দীনতার তরিবৎ সুরাহা হবে। কেননা, পর্যটক যতদিন থাকবে ততদিন সে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করেই চলে যাবে যা তাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্থানীয় অর্থনীতির ভিত শক্ত করার সুযোগে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তিও মজবুত হবে এবং আখেরে তাদেরই লাভ বেশি।

 

বেশকিছু দিন থাকার সুবাদে এবং অফিশিয়ালি কিছু কাজ থাকায় আমি রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কিছু অফিস-আদালত গিয়েছি এবং লক্ষ্য করেছি কোনরকমে উপরি ইনকাম অর্থাৎ ঘুষ ছাড়াই একটা সিস্টেমের মধ্যে জনগণ তার কাজ করতে পারছে। আমার গায়ের চামড়া মোটামুটি শ্রীলঙ্কার মানুষদের চেয়ে খুব একটা পার্থক্য না থাকায় কথা বলার আগপর্যন্ত কেউই আমাকে বিদেশি ভাবতে পারেনি বিধায় তাদের কার্যক্রম খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়েছে বলেই মনে হয়। সবশেষে যেদিন তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসে গেলাম গিয়ে তো আমার বিস্মিত হওয়ার পালা কেননা সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা কাকে বলে তা আমাদের দেশের পররাষ্ট্র থেকে স্বরাষ্ট্র বিভাগের মতো যেকোন মন্ত্রণালয়ের অফিসে গেলে চোখে পড়বেনা। সার্টিফিকেট কিংবা কোনকিছু সত্যায়িত করতে গেলে কতটুকু হ্যাপা তা প্রতিটি বাংলাদেশীর কমবেশি জানা আছে কিন্তু শ্রীলঙ্কায় আপনি গেলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন নিশ্চিত কেননা তাদের বহির্গমণে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও সত্যায়ন করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে অফিস আছে সেখানে সমন্বিত সেবার আওতায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের লোকজন আছে এবং কাগজপত্র জমা দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ডেস্কের কর্মকর্তা নির্দিষ্ট ফি নিয়ে আপনার হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে একটা প্রাপ্তিস্বীকারপত্র দিয়ে দিবে যেখানে কি কি কাজের জন্য কত টাকা জমা দিয়েছেন আর কখন ফেরত দেবে তার সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

 

 

 

যাহোক, পর্যটকের সঙ্গে আচরণ নিয়ে লিখতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলাম বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলোনা বলে দুঃখিত। একজন বিদেশি পর্যটকের সঙ্গে অগ্রহণযোগ্য আচরণের ভিডিও ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে এবং মানুষরূপী কিছু অমানুষের বাচ্চাদের চেহারাও দেশবাসীর মতো বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়ে গেছে কিন্তু আমার দেশের প্রশাসনের কারো নজরে পড়েছে কিংবা সরকারের দায়িত্বশীলদের কেউ এবিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে এখনো জানা যায়নি বলেই মনে হয়। জানিনা আদতেই তা কারো নজরে আসবে কি-না যথেষ্ট সন্দিহান কেননা ইতিপূর্বে সিলেটের পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় চাঁদাবাজদের ব্যাপারে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটকদের কয়েকটি ঘটনা ধারাবাহিকতায় প্রকাশ পেয়েছিল কিন্তু কেউ আইনের আওতায় গ্রেফতার, চাকরিচ্যুত কিংবা কোন বিচার হয়েছে বলে কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।

ধর্মের খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেশবাসীকে কতটুকু মানুষ করা যাবে তা মাদ্রাসা হুজুর কর্তৃক ধর্ষণ ও বলাৎকারের সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী ধর্ষণ ও অপরাধের ধরন অনুযায়ী বুঝতে অন্তত সচেতন মানুষ হিসেবে কারোরই বুঝতে বাকি নেই বরং বিশেষ অনুভূতির জোরেই দে-শ এগিয়ে যাবে আর দেশের জনগণের নীতিনৈতিকতা ভ্রষ্ট হয়ে দেশ রসাতলে গ্যালো বলার চেয়ে উন্নয়নের ফিরিস্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় সুবিধাজনক এবং আমি একজন সরকারের পক্ষের লোক বলে জাহির করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

মোয়াজ্জেম হোসেন তারা

অনলাইন এক্টিভিস্ট, ফ্রান্স

 

 

লেখকের ব্যাক্তিগত মতামত,






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*