শিশুর প্রতি যত্নবান হোনঃ
শিশুরাই পৃথিবীর হাসি-গান-আনন্দের নিরন্তর উৎস -মোহাম্মদ হাসান
শিশুরাই ভবিষ্যত কর্ণধার। ভবিষ্যত শান্তি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নির্ভর করে শিশুদের ওপর। সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়বে এ শিশুরাই। পৃথিবীর হাসি-গান-আনন্দের নিরন্তর উৎস হলো তারা। আজকের শিশুরাই আগামীর স্বপ্নময় ভবিষ্যতের দিশারী। এদের মধ্যে কেউ হবে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাষ্ট্রনায়ক প্রভৃতি। আবার কেউ ঝরে যাবে ভবিষ্যতের ক্রুর, বৈরী পৃথিবীর ক্ষুধা দরিদ্র, পুষ্টিহীনতা, নিরাপত্তাহীনতার আবর্তে।
জার্নাল অব ফাংশনাল মর্ফোলজি অ্যান্ড কিনেশিয়োলজিতে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় জানিয়েছেন শিশুদের ছেড়ে দিন। মুক্ত করে দিন তাদের। তারা যেন নিজেদের মতো খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। পাশাপশি তাদের দিতে হবে পুষ্টিকর খাদ্য। আর এর মাধ্যমেই শিশুর বৃদ্ধি ও সম্পূর্ণ মানসিক বিকাশ সাধন হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উপযোগী শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে স্কুলগুলোতে শিশুদের ওপর বই আর পড়ার চাপ ক্রমেই বাড়ছে।
অভিভাবকরাও ছুটছেন ভালো রেজাল্টের দিকে।
বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনার চাপ কতটা আর কেনইবা এ অবস্থা?
বাংলাদেশে বিভিন্ন স্কুলগুলোতে শিশুদের পড়াশোনার জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে, সে ব্যবস্থায় শিশুদের উপর পড়াশোনার চাপ বা বইয়ের বোঝা নিয়ে বিতর্ক বা আপত্তি নতুন কিছু নয়।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রাক প্রাথমিকে শিক্ষার স্তর একটি হলেও কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, সেগুলোতে নার্সারী, প্লে, কেজি ওয়ান, কেজি টু’সহ তিন থেকে চারবছর ধরে পড়ানো হয় শিশুদের।
আবার এ সময় শিশুদের খেলায় খেলায় মাতৃভাষা, অক্ষর ও সংখ্যার ধারণা দেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে স্কুলগুলোতে শিশুদের গ্রামার এমনকি বিজ্ঞানও পড়ানো হয়।
পাঠ্যবই থাকে ৬ থেকে ১২টি পর্যন্ত।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্যবই নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ৩টি।এছাড়া তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই নির্ধারিত আছে ৬টি করে।
সরকারি স্কুলগুলো এ কারিকুলাম অনুসরণ করলেও বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ানো হচ্ছে কারিকুলামের বাইরে ৭ থেকে ৮টি করে অতিরিক্ত বই।
সাধারণভাবে মনে করা হয় যে শিশুদের জন্য কিল, থাপ্পড় বা চড় হয়তো তেমন ক্ষতিকর নয়। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের মারধোর বা লাঠি দিয়ে পেটানো শিশু স্বাস্থ্যের এমনকি তার জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। মেরুদন্ডের নিচের দিকে সামান্য থাপ্পড়ের ফলে সমস্ত মেরুদন্ডে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। প্রাপ্ত বয়সে আমাদের অনেকের পিঠ বা কোমর ব্যথা দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ হচ্ছে বাল্যকালে সেসব চড় থাপ্পড়ের ফল। এ ধরনের শাস্তির ফলে যদি কোন স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয় তবে শিশুর শরীর আংশিক বা পূর্ণভাবে চলৎশক্তিহীন হয়ে যেতে পারে। হাত পা অথবা বুকের খাঁচার হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। অনেকক্ষেত্রে গভীর কোন ক্ষত থেকে ক্যান্সারের জন্মও হতে পারে। চড় থাপ্পড়ের চেয়েও ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার শিশু শ্রমিকরা। মালিক বা গৃহকর্ত্রীর কিল, ঘুষি, লাথি, সজোরে ধাক্কা, শরীরের কোন একটা অংশ পুড়িয়ে দেয়া, গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা, গরম খুন্তি দিয়ে সেঁকা দেয়া, নির্জন প্রকোস্টে বা বাথরুমে দিনের পর দিন আটকে রাখার কথাতো সর্বজনবিদিত। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ছোট শিশুদের জোরে ঝাঁকুনি শিশু শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। শারীরিক বৃদ্ধি বিঘœ, বমি,স্নায়ু বৈকল্য, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি শিশু মনে বড়দের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। ফলে তাদের মনের যা কিছু সুন্দর ও কমনীয়তা হারিয়ে যায়। কোমল শিশুর মনে জন্ম নেয় সবকিছুর বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা। এগুলো ফুটে ওঠে কিশোর কিশোরী, তরুণ-তরুণীর অস্বাভাবিক আচরণ ও অপরাধ প্রবণতার মধ্যদিয়ে।
এসবের কারণ হল মার খাওয়া শিশুর মধ্যে উগ্রতা, হিংস্রতা দেখা যায় বেশি এবং সহজেই সে অন্যকে আঘাত করে। কথায় বলে, যে মার খায় সে অন্যকে মারতে শেখে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত শিশু বাল্যকালে খুব মারধোর খেয়েছে কিশোর বা প্রাপ্ত বয়সে তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব ও নিষ্ঠুরতা দেখা যায়। সমাজের বিপজ্জনক সকল অপরাধীর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে বাল্যকালে এরা প্রচ- রকমের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আসলে বাচ্চারা বাবা মা ও বড়দের আচরণ দেখে শেখে এবং অনুকরণ করে। তাই তাদের সামনে ধৈর্র্য্য, সহানুভুতি ও মায়ামমতার উদাহরণ স্থাপন করাই শ্রেয়।
নিয়মিত শারীরিক আঘাত প্রাপ্তি ও বকাঝকা খাওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিশু মানসিকভাবে ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে। বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ড. মেহতাব খানমের মতে, এর ফলে শিশুর পরবর্তী জীবনে যে কোন কর্তৃপক্ষ, অফিসের বস, এমনকি স্বামী অথবা স্ত্রীর সামনেও ভীত বিহ্বল আচরণ করে। বাল্য বয়সে অথবা পরবর্তী জীবনে তার মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটতে পারে না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নির্যাতিত হওয়ার পরও দুর্বল শিশুটি বাবা মা, শিশু অথবা গৃহকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না। ফলে তার মনে জন্ম নেয় হিংস্রতা, ক্রোধ। পরবর্তী জীবনে যে কোন সমস্যার সমাধানে যে সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত উপায়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বরং গায়ের জোরে সকল সমস্যার সমাধান করতে চায়। শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে ভালবাসার যে বন্ধন, শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্মান ও স্নেহের যে সম্পর্ক বড় ও ছোটদের মধ্যে আদর-ভালোবাসার সম্পর্ককে নষ্ট করে। শারীরিক শাস্তি হয়তো সাময়িকভাবে শিশুকে কথা শোনাতে বাধ্য করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা ফলদায়ক নয়। কারণ প্রকৃতিগতভাবেই যারা শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে তাদের প্রতি শিশুর ভালোবাসা জন্মায় না। বরং আদর, ভালোবাসা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে শিশুর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক গড়ে উঠে তা হয় সহযোগিতামূলক, স্থায়ী ও দৃঢ়।
যে সব খারাপ কাজের জন্য আমরা শিশুদের শাররিকভাবে আঘাত করি তার পূর্বে সেসব কাজের পেছনের কারণগুলোর সমাধান করা উচিত। কম ঘুম, কম খাবার, অপুষ্টি ও শারীরিক অসুস্থতা এবং মুক্ত বাতাস, শরীর চর্চা, নিজের জগতে অবাধ বিচরণের সুযোগের অভাবে শিশুর মধ্যে দেখা দেয় অস্থিরতা, মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমী, কাজে অমনোযোগিতা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি। আজকের ব্যস্ত এ নগরজীবনে নানা জটিল সমস্যার আবর্তে নিপতিত বাবা মা ছেলেমেয়েদের সময় দিতে পারেন না। সঠিক নজরদারির অভাবে বাচ্চাদের অনেক সমস্যাই থেকে যায় চোখের অন্তরালে। তাই আদর-যত্ন বঞ্চিত এসব শিশুদের যে কোন ত্রুটিতে মারধর করা খুবই অন্যায় এবং ছোট মানবশিশুটির প্রতি নির্যাতনসম।
বিভিন্ন বয়সের শিশুকে বিভিন্নভাবে কথা শোনানোর চেষ্টা করতে হবে। শিশু যদি মাত্র হাঁটতে শেখার বয়সে থাকে এবং কোন খারাপ কাজ করতে যায় তবে তাকে চোখ পাকিয়ে খুব জোর করে ‘না’ বলতে হবে। বেশির ভাগ শিশুর ক্ষেত্রেই এ কৌশল কাজ দেয়। তবে কোন কোন শিশু থাকে খুবই নাছোরবান্দা। কথায় কাজ না দিলে সেক্ষেত্রে বাচ্চাটিকে উক্ত স্থান থেকে সরিয়ে নিরাপদ অন্য কোন কক্ষে বা স্থানে নিয়ে যেতে হবে। মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর জন্য খেলনা বা আঁকাআঁকির জন্য রং পেন্সিল ও কাগজ বা খেলনা দিয়ে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে।
তিন চার বছরের বাচ্চা বাবা মায়ের মনোযোগ আর্কষণের জন্য অধিক দুষ্টুমি করে থাকে। এজন্য তাকে সময় দিতে হবে, কথা শুনতে হবে, আপনি যদি খুব বেশি ব্যস্ত থাকেন তবে তাকে সে কথা যথাসাধ্য বুঝিয়ে বলুন। তাকে প্রতিশ্রুতি দিন যে পরে তাকে সময় দেয়া হবে বেশি বা আজকে রাতে আরেকটা গল্প বেশি বলবেন। প্রতিশ্রুতি দিলে তা অবশ্যই রাখতে চেষ্টা করবেন, অন্যথায় শিশু আপনার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এ বয়সের শিশু প্রশংসা পছন্দ করে বেশি। তাই তার ভালো কাজের প্রশংসা করতে ভুলবেন না। আর বাচ্চারা তো দুষ্টুিম করবেই। সে দুষ্টুমি যদি ক্ষতিকর না হয় তবে তা দেখেও না দেখার ভান করাই শ্রেয়। সন্তানটি যদি বাড়ির বাইরে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে বা পার্কে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা করে তবে জনসমক্ষে তাকে মারধোর না করে বুদ্ধিমানের কাজ হবে অতি দ্রুত উক্ত স্থান ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে আসা এবং যতটুকু সম্ভব তাকে খারাপ আচরণের কুফল সম্পর্কে বোঝানো কিন্তু তা চড়, থাপ্পড়ের মাধ্যমে অবশ্যই নয়। স্কুলে যাওয়ার বয়সে বিশেষ করে সাত বছর হয়ে গেলে শিশুর মধ্যে বয়স, স্কুলের পরিবেশ, পড়াশুনা ও খেলাধুলার ব্যস্ততা, বাবা মায়ের উপদেশ সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ সবকিছু মিলিয়ে শিশুর আচরণ ধীরে ধীরে সুসংহত হতে থাকে।
সূত্রঃ জার্নাল অব ফাংশনাল মর্ফোলজি অ্যান্ড কিনেশিয়োলজিতে প্রকাশিত এক সমীক্ষা ও বিবিধ প্রতিবেদন।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।