ধর্ষণ যাচাইয়ে নিষিদ্ধ ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’
কোনো নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে কি না তা যাচাইয়ে দেশে প্রচলিত ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নামে হাতের দুই আঙুল দিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতি অবৈধ ঘোষণা করে তা নিষিদ্ধ করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ধর্ষণের পরীক্ষায় ‘পিভি টেস্ট’ নামে পরিচিত যে ‘বায়ো ম্যানুয়াল টেস্ট’ (আঙুল দিয়ে ওভারির অবস্থান নির্ণয় করা) তাও নিষিদ্ধ করেছেন আদালত।
এখন থেকে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে ২০১৭ সালে সরকার ঘোষিত নীতিমালা (প্রটোকল ফর হেলথ কেয়ার প্রভাইডার) কঠোরভাবে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে ধর্ষণের পরীক্ষা করা যাবে বলে উল্লেখ করেছেন আদালত।
বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি এ কে এম সাহিদুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এ রায় দেন। ২০১৩ সালে এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে এ রায় দিয়েছেন আদালত। রায়ে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা ও অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেছেন, বাংলাদেশে ধর্ষণ যাচাইয়ে দুই আঙুলের সাহায্যে প্রচলিত যে পরীক্ষা পদ্ধতি তা আইনসম্মত বা বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। এমনকি এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা বিশ্বাসযোগ্যও নয়।
রায়ে আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর পরীক্ষা করতে হবে একজন নারী চিকিৎসক বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে। ওই সময় একজন নারী গাইনোকোলজিস্ট, একজন নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ভুক্তভোগীর একজন নারী আত্মীয়, একজন নারী পুলিশ সদস্য ও নারী সেবিকা রাখতে হবে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যে সনদ দেবেন তাতে ‘অভ্যাসগত যৌনতা’ বলে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। পরীক্ষার পর ধর্ষিতার সব গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া বিচারাধীন মামলায় নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণকালে নারীকে অমর্যাদাকর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
রায়ে বলা হয়, যদি ধর্ষিতার আঘাত বা ক্ষত গভীর থাকে, সে ক্ষেত্রে একজন গাইনোকোলজিস্টের কাছে তাকে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঠিক কোন কারণে ধর্ষিতার এই গভীর ক্ষতের পরীক্ষার প্রয়োজন তা লিখতে হবে। কোনো আঘাত বা ক্ষত না থাকলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর ক্ষেত্রে ‘স্পার্স স্পেক্যুলাম’ (এক ধরনের যন্ত্র দিয়ে যৌনাঙ্গ এলাকায় পরীক্ষা করা) পরীক্ষা করা যাবে না।
রায়ে উল্লেখ করা হয়, এরই মধ্যে ভারতে ধর্ষণের শিকার নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় দুই আঙুলের পদ্ধতি নিষিদ্ধ করেছে সরকার। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় ডিএনএ টেস্ট করা হয়। তাই প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে ধর্ষণের পরীক্ষা করা যাবে।
রায়ে সরকার ঘোষিত হেলথ কেয়ার প্রটোকল ব্যাপকভাবে প্রচার এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে বিশেষ করে চিকিৎসক, আদালত, পিপি (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল), ধর্ষণ মামলায় পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা ও আগ্রহী আইনজীবীর কাছে সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হেলথ কেয়ার প্রটোকল বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সেমিনার করতেও বলেছেন আদালত।
ধর্ষণ যাচাইয়ে হাতের আঙুলের মাধ্যমে পরীক্ষা পদ্ধতি কেন অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর একটি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ধর্ষণের পরীক্ষার বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। তিন মাসের মধ্যে এই কমিটিকে একটি খসড়া নীতিমালা করে আদালতে দাখিল করতে বলেছিলেন আদালত। এ নির্দেশের পর ধর্ষণের পরীক্ষার ক্ষেত্রে সরকার গত বছর একটি নীতিমালা তৈরি করে।
ধর্ষণ যাচাইয়ে দুই আঙুলের মাধ্যমে পরীক্ষা পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর করা এক রিট আবেদনে ওই রুল দিয়েছিলেন আদালত। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারীপক্ষ এবং ডা. রুচিরা তাবাচ্ছুম ও ডা. মোবারক হোসেন খান এ রিট আবেদন করেন। তাঁদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ।