প্রাণের ৭১

লুই বেনেডিক্ট জামরঃ ফরাসি বিপ্লবে চট্টগ্রামের ছেলে

জামরের প্রতিকৃতি; ছবিটি অতিরঞ্জিত, সম্ভবত কল্পিত; ফ্রান্সের ল্যুভর জাদুঘরে সংরক্ষিত এ ছবির শিল্পী মারি–ভিক্তোয়ার লোমোয়ান, ১৭৮৫

১৭৭৩ সাল। চট্টগ্রাম উপকূলে ইংরেজ দাস-ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়ল ১১ বছরের জামর। তারপর? চট্টগ্রামের এ ছেলেটি কীভাবে ফরাসি বিপ্লবের লড়াকু যোদ্ধা হয়ে উঠল?

 

১৭৯০ এর দশক। ফরাসি বিপ্লবের আগুনে উত্তাল ফ্রান্স। ফরাসি রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা চিরতরে বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়ার পথে। সারা পৃথিবী তখন ধন্য ধন্য করছে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বা জিন-জ্যাক রুশোর মতো এই বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত কিংবদন্তি নেতাদের। কিন্তু এঁদের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন একজন বাংলার শিকড়ের সঙ্গে জড়িত নেতাও, যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লবের।

 

 

 

 

বর্তমান বাংলাদেশেরর চট্টগ্রাম অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করলেও, সম্ভবত সিদ্দি বা হাবশী জনগোষ্ঠীর এই নেতার নাম ছিল লুই বেনেডিক্ট জামর। তাঁর প্রাথমিক জীবন সম্বন্ধে যে সামান্য তথ্য পাওয়া যায়, তাতে জানা যাচ্ছে যে, জামরের জন্ম ১৭৬২ সালে। ফরাসি কাউন্টেস ডু ব্যারির লেখায় তাঁকে ‘আফ্রিকান’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি চিরতরে বিশ্বকে পরিবর্তিত করে এমন একটি মানুষের বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন।

 

 

 

যতদূর জানা যায়, কিশোর বয়সেই জামরকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফরাসি দাস-ব্যবসায়ীরা ধরে নিয়ে যায়। সেই সময় চট্টগ্রাম ছিল প্রাচ্যের অন্যতম সেরা বন্দর। সারা পৃথিবী থেকে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা লেগেই থাকত সেখানে। তখন দাস ব্যবসাও কোনো অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে জামরকে ক্রীতদাস হিসেবে মাদাগাস্কার হয়ে ফ্রান্সে চালান করা হয়। প্রাসাদের দাস হিসাবে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের কাছে তাঁকে বিক্রি করা হলেও, রাজা জামরকে তাঁর উপপত্নী ডু ব্যারিকে উপহার দিয়েছিলেন। ব্যারিই তাঁর নাম লুই-বেনেডিক্ট জামর রেখেছিলেন। সেখানেই ডু ব্যারির কাছে কাজ করতে করতে জামরের ফরাসি সাহিত্য, সংস্কৃতি বিশেষত জিন-জ্যাক রুশোর সৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বিপ্লবী দলের সঙ্গেও গোপনে যোগাযোগ হয় তাঁর।

 

 

 

 

১৭৯৮ সালে, জামরের যখন ২৮ বছর বয়স, তখনই পুরোদমে ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। রুশোর লেখা পড়ে অনুপ্রানিত জামর অবশ্যম্ভাবী ভাবে বিপ্লবীদের এবং জ্যাকোবিনদের পক্ষ নিয়েছিলেন। ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন সম্রাট এবং তাদের আমোদপ্রমোদে ভরা জীবনযাত্রাকে।

 

 

ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে জামরই একমাত্র বাংলা থেকে যাওয়া ব্যক্তি, যিনি বিপ্লবে প্রত্যক্ষ ভাবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি গ্রিভসের বিপ্লবী দলে যোগদান করেন ও পাবলিক সেফটির কমিটির সদস্যও হন। যদিও রাজপরিবারে জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর, রাজদ্রোহের অপরাধে কাজ হারাতে হয় তাঁকে। ১৭৯২ সালে মাদাম ডু ব্যারির বিচারের সময় জামর তাঁর সাবেক মালকিনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেন এবং ফাঁস করে দেন তাঁর বিপ্লব বিরোধী ষড়যন্ত্রের কথা। বিচারে ডু ব্যারির মৃত্যুদণ্ড স্থির হয়।

 

 

 

 

 

 

তবে, পূর্বে রাজপরিবার বিশেষত ডু ব্যারির সাহচর্যে লালিতপালিত হওয়ার অপরাধে কারাদণ্ড হয়েছিল জামরেরও। তবে কিছুদিন পরেই তাঁর সঙ্গীদের সহায়তাতেই মুক্তি লাভ করেন তিনি। বিচারে সময় দেওয়া তাঁর সাক্ষ্য থেকেই বিশ্ব জানতে পারে জামর আদতে জন্মসূত্রে বাংলা সুবাহের চট্টগ্রামে বাসিন্দার ছিলেন। এর পরে জামর আরও সোচ্চার এবং সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন বিপ্লবে। কালক্রমে তিনি বিপ্লবী সরকারের সেক্রেটারি পদস্থও হয়ে ওঠেন

 

যদিও জামোরের এই অসাধারণ উত্থানের কাহিনি থমকে যায় হঠাৎ করেই। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি ফ্রান্স থেকে পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দেন। পরে আবার ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের পতনের পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন ফ্রান্সে।

 

 

প্যারিসের লাতিন কোয়ার্টারের কাছে একটি বাড়ি কিনেছিলেন জামোর। সেখানে প্যারির এক দরিদ্র পল্লীতে শিক্ষকতা করতেন তিনি। শেষ জীবন অপরিসীম দারিদ্র্যে কাটিয়েছিলেন জামোর। ১৮২০ সালে জামরের মৃত্যুর পর প্যারিসের একটি নামহীন কবরে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। শোনা যায়, মৃত্যুর পর জামরের ঘরে পাওয়া গিয়েছিল বিপ্লবী মারাট, রোবসপিয়েরের ছবি। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে একমাত্র ‘বাঙালি’ লুই বেনেডিক্ট জামরের একটি ছবি আঁকেন ফরাসী শিল্পী মারী ভিক্তর লোমোয়ান।

উইকি,ইন্টারনেট।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*