শতভাগ বিদ্যূতের দ্বারপ্রান্তে সোনার বাংলা: মোহাম্মদ হাসান
মনে হয় যেন সেদিনই তো হাটবারে হাঁট থেকে আধা সের কেরসিন কিনতে হতো আমার মত দেশের দুই তৃতীয়াংশ পরিবারকে। নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি দিনগুলোতেও এমন চিত্র হরহামেশাই দেখেছি বেশ। ভাবতে বেশ ভালোই লাগছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা’র হাত ধরে আমজনতার জীবন যাত্রার মান বেড়েছে বেশ। সে আঁধারের যুগ পেরিয়ে দেশ শতভাগ বিদ্যুতের দ্বারপ্রান্তে সোনার বাংলা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের গত দু’মেয়াদে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ খাতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নিয়ে ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ-ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ এ স্লোগানে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) কর্তৃপক্ষ দেশের সকল গ্রামগুলো আলোকিত করার কাজ করে যাচ্ছে। সারা দেশে শতভাগ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতে বিদ্যুৎ খাতে চলমান বিশাল কর্মযজ্ঞেরও যবনিকা পাত হতে চলছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের দ্বারপ্রান্তে দেশ। বিদ্যুৎ সেবার মধ্যে এসেছে জাতীয় গ্রিডের আওতায় থাকা সব গ্রাম ও পরিবার। শুধু বাকি রয়েছে গ্রিড এলাকার বাইরে থাকা ৩ লাখ ৭ হাজার ২৪৬ পরিবার। এ পরিবারগুলোতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বললে সব নাগরিককে বিদ্যুেসবার আওতায় আনার মাইলফলক অর্জিত হবে। আগামী মার্চের মধ্যে এ পরিবারগুলোতেও বিদ্যুত্ পৌঁছে যাবে। স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিববর্ষ পূর্তিতে দেশের সব নাগরিক পাবেন বিদ্যুৎ সুবিধা । আলোয় উদ্ভাসিত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
গেলো উনিশ ডিসেম্বর জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে মাহবুব রনি’র ‘শতভাগ বিদ্যুতের দ্বারপ্রান্তে দেশ’ শিরোনামের একটি সংবাদ। তাতে একপর্যায়ে তিনি এভাবে লিখেছেন, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং বিতরণ কোম্পানিগুলো সূত্র জানায়, গত নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৯৮ শতাংশ গ্রাম-পরিবার বিদ্যুত্ সংযোগ পেয়েছে। ৯৮ হাজার ৩১৯টি গ্রামের মধ্যে ৯৫ হাজার ২৪০টি গ্রাম শতভাগ বিদ্যুতায়িত করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা-কোম্পানিগুলো। এখন বাকি রয়েছে ৩ হাজার ৭৯টি গ্রাম। এ সবগুলো গ্রামই পার্বত্য, দ্বীপ এবং চরাঞ্চলের। এগুলোতে গ্রিড বিদ্যুৎ সরাসরি পৌঁছানো যায়নি। তাই বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি-বিশ্লেষণী সংস্থা পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, বিতরণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাম বাকি রয়েছে বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। এ সংস্থার আওতাধীন ২ হাজার ৫২ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। শতভাগ বিদ্যুতায়নের পথে সবচেয়ে বেশি মাইলফলক অর্জনকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতায় ১ হাজার ১৪টি গ্রাম বাকি রয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতায় ৯টি গ্রাম এবং উত্তর অঞ্চলের কোম্পানি নেসকোর আওতায় ১৭টি গ্রামে বিদ্যুতায়ন হয়নি। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে দায়িত্বরত দুই সংস্থা—ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) আওতাধীন এলাকায় সব পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং মুজিব শতবর্ষকে সামনে রেখে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। সে লক্ষ্য নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
চলতি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংসদ সদস্যদের দেওয়া চিঠিতে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১৫ অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ চেষ্টায় বিদ্যুত্ উপাদন সক্ষমতা (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। এরই মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন সাত জেলা এবং ২৮৮টি উপজেলা প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। মুজিববর্ষের মধ্যে অবশিষ্ট উপজেলা গুলোতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ সম্পন্ন করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে ৩ কোটি ৮৭ লাখ এবং দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। অবশিষ্ট ২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের অবস্থান প্রত্যন্ত অফগ্রিড এলাকাসমূহে। এ সব এলাকায় সাবমেরিন ক্যাবল এবং সোলার মিনিগ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুই পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, শতভাগ বিদ্যুতায়নের পথে অনেক বাধা ছিল। এখনো আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় সেসব বাধা পেরিয়ে এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে আমরা। বিদ্যুত্ উত্পাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত নিয়োজিত সবাই একটি দল হয়ে কাজ করার ফলাফল হলো—নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে এ অর্জন।
সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলাকে জাতীয় গ্রিডের আওতায় আনা হয়েছে। কক্সবাজারের প্রায় ২১৫ বর্গকিলোমিটারের কুতুবদিয়া দ্বীপকেও পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুতায়নের কাজ চলমান রয়েছে। নোয়াখালীর হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের জন্যও একই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আইপিপিপির মাধ্যমে হাতিয়া দ্বীপে ৮ থেকে ১০ মেগাওয়াট তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করছে পিডিবি।
আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন জানান, তার সংস্থায় আওতায় ৪৬২টি উপজেলার মধ্যে ৪৬১টিতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়েছে। অফগ্রিডে থাকা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ চলছে।
পার্বত্য তিন জেলায় ৫৬ হাজার গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কাজ চলমান রয়েছে। এর বাইরে দুর্গম পাহাড়ে থাকা আরো ৪০ হাজার পরিবারের কাছে গ্রিড লাইনের বিদ্যুৎ নেওয়া সম্ভব নয়। সেখানে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুত্সংযোগ দেওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। রংপুর ও রাজশাহীতে গ্রিডের বাইরে থাকা দুর্গম চরে বিনা মূল্যে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করছে নেসকো। এতে ১৩টি চরে বসবাসরত ১২ হাজার ৬৯০টি পরিবার সৌরবিদ্যুৎ পাবে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেই নব্বইয়ের দশকে এই সাবমেরিন নিয়ে সরকার প্রধান ও সরকার দলের পদক্ষেপ এবং অপরিপক্ক যুক্তি উপস্থাপন জাতিকে হতাশও করেছিলো বেশ। দেশরত্ন শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় সেই সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা মুজিবের বাংলায় দ্বীপ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবে সাবমেরিনে, আর পার্বত্য ও দুর্গম এলাকায় সৌর বিদ্যুৎ-এ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন গিয়েছিল বলে সে পথ ধরে আজ তথ্যপ্রযুক্তি সহ শতভাগ আলোর পথে জাতির পিতার সোনার বাংলা।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।