প্রাণের ৭১

চারশো বছর লাগে মাটিতে পলিথিন পঁচতে: মোহাম্মদ হাসান

আজ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক এ সুপারিশ মালায় প্রাধান্য ছিল বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমাটবাধা পলিথিন অপসারণ করার বিষয়টি।

পলিথিন হচ্ছে ইথিলিনের পলিমার যাকে আমার প্লাস্টিক বলে জানি। পলিমারাইজেশন প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়ে পলিথিন গঠন করে। পলিথিন সাদা অস্বচ্ছ নমনীয় কিন্তু শক্ত।

নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না৷ এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যের আকার নেয়৷ মানুষের অসচেতনতাই প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ ৷ প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে পচতে অথবা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে ৷ তাই একে “অপচ্য পদার্থ” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে ৷ সাধারনত উদ্ভিদকূল, জলজ প্রাণী, দ্বীপ অঞ্চলের প্রাণীরা প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে৷ প্লাস্টিক বর্জ্য ঐসকল প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহের স্থান ও উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র উদ্ভিদ বা জলজ প্রাণী নয়, মানুষ প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ৷

থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের জন্য প্লাস্টিক দূষণ পরোক্ষভাবে দায়ী৷ শুধুমাত্র আমেরিকাতে প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয় ৷ এগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন হয়ে থাকে ৷ অন্য ৩.৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আকারে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়৷বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ৷ বাংলাদেশেও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে আইন রয়েছে যদিও প্রয়োগ যৎকিঞ্চিত।

প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপত্তির স্থান থেকে বিভিন্ন উপায়ে ভিন্ন ভিন্ন আকারে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে ৷ সমুদ্র স্রোত, বাতাসের অসম গতি, ভৌগলিক বৈচিত্রতার কারণে প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে পড়ছে ৷ ক্যারিবিয়ান সমুদ্র অঞ্চলে গেলে তা ভালভাবে উপলব্ধি করা যায় ৷ ঐসব অঞ্চলে সাধারণত মাইক্রো ও ম্যাক্রো আকারের প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যায় ৷ যেহেতু প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ , তাই সৃষ্টির পর পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে অবস্থান করে ৷ এটি নিয়মিত প্রাণীর খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে (মাইক্রো কণাসমূহ) ,যা প্রাণীর জন্য খুবই বিপদজনক ৷ বিভিন্ন উপায়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের ভারসম্যকে নষ্ট করে চলছে।

পলিথিন মাটিতে পচতে সময় লাগে ৪০০ বছর। আর এভাবেই পানি গ্রহণের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি ৷মাটিতে বিভিন্ন ধরনের অনুজীব বাস করে যা প্লাস্টিক অণুর ভাঙনে সাহায্য করে ৷ এইসকল অণুজীবের মধ্য “সিউডোমোনাস( Pseudomonas)” , “নাইলন খাদক ব্যাকটেরিয়া (nylon-eating bacteria)” , ” ফ্লাভো ব্যাকটেরিয়া ( Flavobacteria) অন্যতম ৷ এইসকল ব্যাকটেরিয়া “নাইলোনেজ” এনজাইম ক্ষরণের মাধ্যমে নাইলন অণুকে ভেঙ্গে ফেলে ৷ জীবাণুবিয়োজ্য প্লাস্টিক ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয় ৷ মিথেন এক প্রকার গ্রীণহাউজ গ্যাস ৷ এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী।

পরিবেশ সংরক্ষণ সংশোধিত আইন ২০০২-এ পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়।

আইনে বলা আছে, ‘সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা’। বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায়ে অনধিক ১ (এক) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
‘পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের দায়ে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা’।

এছাড়াও আইনের ৬(ক) ধারায় বলা হয়েছে ‘সরকার মহাপরিচালকের পরামর্শ বা অন্য কোনোভাবে যদি সন্তুষ্ট হয় যে, সকল বা যেকোনো ধরনের পলিথিন শপিং ব্যাগ বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্য কোনো সামগ্রী বা অন্য যেকোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাহলে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে সারা দেশে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় এ ধরনের সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ওই সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করতে পারবে।

এবং ওই নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বাধ্য থাকবেন’। ‘তবে শর্ত থাকে যে, ওই নির্দেশ যেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না তারমধ্যে , (ক) ওই প্রজ্ঞাপনে বর্ণিত সামগ্রী রফতানি করা হলে বা রফতানি কাজে ব্যবহৃত হলে। (খ) কোনো নির্দিষ্ট পলিথিন শপিং ব্যাগের ক্ষেত্রে ওই নির্দেশ প্রযোজ্য হবে না মর্মে ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হলে’৷‘পলিথিন শপিং ব্যাগ’ বলতে বোঝানো হয়েছে পলিইথাইলিন, পলিপ্রপাইলিন বা এর কোনো যৌগ বা মিশ্রণের তৈরি কোনো ব্যাগ, ঠোঙ্গা বা অন্য কোনো ধারক যা কোনো সামগ্রী কেনা-বেচা বা কোনো কিছু রাখা বা বহনের কাজে ব্যবহার করা যায়৷

বছর তিনেক আগে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলানিউজের সাথে বলেছিলেন, ‘দেদারসে পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজার থেকে কিনলেই পলিথিন দেওয়া হচ্ছে। যেমন- মাছ, গুড় বা এ জাতীয় পণ্য বহনে পলিথিন ছাড়া উপায় নাই। কিন্তু আইন যেহেতু আছে, সেহেতু এর ব্যবহার অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আইন মানতে হবে, আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে’।

সেখানে তিনি কেউ যেন পলিথিন উৎপাদন করতে না পারেন তার জন্য আইনের প্রয়োগ বাড়ানোর কথাও বলেছিলেন।

একইভাবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল মতিন তখন বলেছিলেন, ‘খুব সহজেই পলিথিন মুক্ত করা যেতো। কারণ, মানুষও চান, পলিথিন মুক্ত হোক। আইনও আছে। কিন্তু সরকার ও প্রশাসন কেন এ আইন প্রয়োগ করছে না- সেটি বোধগম্য নয় বলে সরকারকে বেশ দূষলেন।

আসলে একটি বিষয় হচ্ছে প্রাচুর্যের মাঝে বসবাস করে শিতল বায়ুর কক্ষে বসে এমন বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে এমন কিছু বলে সরকারকে জ্ঞান দিতে হরহামেশাই দেখা যায়। অথচ তাঁরাই আবার বৌ বাচ্চা সাথে নিয়ে বৈকালিক হাওয়া গায়ে লাগাতে গিয়ে পার্ক কিংবা বিনোদন কেন্দ্রে বেড়াতে বচ্চার বায়না চিপস স্ত্রী লেবু চা তাও কিন্তু প্লাস্টিক পেয়ালায়। খাওয়া ও পান শেষে দু’জন দু’দিকে ছুঁড়ে ফেলে সাহেবে বাহু ধরে পুনরায় দুলতে দুলতে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলছেন। তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়না।

তাছাড়া অজপাড়াগাঁয়ে গ্রামীণ হাটে সদাই কিনতে সবজি দোকানে গেলে আলু, পিঁয়াজ, রশুন,নফুলকপি, কাঁচা মরিচ ধনেপাতা সবগুলো আলাদা আলাদা করে বেশ আধুনিকতার সাথে ভদ্রভাবে হাতে তুলে দেন। আর ঐ সদাই ঘৃহকর্তীর হাতে আসে তিনেও সেগুলো যত্ন সহকারে তুলে রাখেন পরে আবার লাগবে বলে। অতপর বছর আধেক শেষে ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে যাবতীয় আবর্জনার সাথে ঐ একগাদা পলিব্যাগ ঘরেরপাশে চলেযায়। তাতেও ঐ পরিবেশবাদিদের বেজার হতে দেখি না। সবাই শুধু সরকারকে এক হাত নিতে ব্যাস্ত। এর পরিত্রাণ কোথায়!

লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বাংলানিউজ।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*